তাকওয়া কী? মুত্তাকী কারা? মুত্তাকীর সংজ্ঞা ও পরিচয়: কীভাবে মুত্তাকী হওয়া যায়?

১. মুত্তাকির সংজ্ঞা কি? মুত্তাকী কে বা কারা?

2. কীভাবে মুত্তাকী হওয়া যায়? 

3. ইবাদত: সিয়াম, হজ্জ¦, কোরবানী ইত্যাদির মূল উদ্দেশ্য কি? 

5. মুত্তাকী: দুআ, যিকির ও তাসবিহ:

📌 নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী-49:13 

📌তাকওয়া অর্জনের নির্দেশ (মুত্তাকি): ৩:১০২, ৩৩:১, ২৬: ১০৬, ১০৮, ১২৪, ১২৬, ২৬: ১৪২, ১৬১, ১৭৭, ২১:৭৩ (২:১০৩)।

তাকওয়া: আল-কুরআনের আলোকে একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা:

১. মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:

সৃষ্টির উদ্দেশ্য: মানুষের প্রধান দায়িত্ব হলো একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা।  আয়াত: ৫১:৫৬, ৯৮:৫, ২১:২৫

ইবাদতের লক্ষ্য: সকল ইবাদতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো তাকওয়া (আল্লাহ-সচেতনতা) অর্জন করা -আয়াত: ২:২১, ২:১৭৯, ২:২১৩

২. তাকওয়ার উৎস ও বিধান:

প্রধান উৎস: তাকওয়া অর্জনের মূল পথপ্রদর্শক হলো আল-কুরআন। কুরআন মুত্তাকীদের জন্যই হেদায়েত।

আয়াত: ২:২-৫, ৩৯:২৭-২৮

সরাসরি নির্দেশ: আল্লাহ তা'আলা ঈমানদারদের তাকওয়া অবলম্বনের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন। আয়াত: ৩:১০২, ৫:৮, ৫৯:১৮

৩. তাকওয়া অর্জনের ব্যবহারিক উপায়:

কুরআন তাকওয়া অর্জনের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারণ করে দিয়েছে:

সিয়াম (রোজা): এর মূল উদ্দেশ্যই তাকওয়া বৃদ্ধি করা।আয়াত: ২:১৮৩

তাকওয়ার পোশাক: বাহ্যিক পোশাকের চেয়ে আত্মিক পরিশুদ্ধি বা তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। আয়াত: ৭:২৬

ন্যায়বিচার ও সততা: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা তাকওয়ার অত্যন্ত নিকটবর্তী। আয়াত: ৫:৮

দান ও সদকা: আল্লাহর পথে ব্যয় করা মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আয়াত: ৩:১৩৩-১৩৪

সত্যবাদীদের সঙ্গ: মুত্তাকী হওয়ার জন্য সত্যবাদীদের সাহচর্য অবলম্বন করা অপরিহার্য। আয়াত: ৯:১১৯

৪. তাকওয়ার পুরস্কার ও মর্যাদা:

তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে মহাপুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন:

আমল কবুল হওয়া: আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের আমলই কবুল করেন। আয়াত: ৫:২৭

আল্লাহর বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা: মুত্তাকীরা আল্লাহর ভালোবাসা ও অভিভাবকত্ব লাভ করে। আয়াত: ৩:৭৬

সর্বোচ্চ সম্মান: আল্লাহর কাছে সম্মানের মাপকাঠি হলো তাকওয়া, বংশ বা সম্পদ নয়। আয়াত: ৪৯:১৩

মুক্তি ও রিযিক: মুত্তাকীদের জন্য আল্লাহ সব বিপদ থেকে মুক্তির পথ এবং অভাবনীয় উৎস থেকে রিযিকের ব্যবস্থা করেন। আয়াত: ৬৫:২-৩

আখেরাতে সাফল্য ও জান্নাত: মুত্তাকীদের জন্যই রয়েছে চূড়ান্ত সাফল্য এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি। আয়াত: ৫১:১৫, ৫৯:১৮

🔖কুরআন সবার জন্য, কিন্তু হেদায়াত মুত্তাকীদের জন্য: 

উদ্ধৃত আয়াতগুলোর (৩:১৩৮, ২৪:৩৪, ১৯:৯৭) মূলকথা হলো—কুরআন থেকে তারাই প্রকৃত অর্থে উপকৃত হতে পারে, যাদের অন্তরে আল্লাহ্‌-সচেতনতা বা ‘তাকওয়া’ রয়েছে। সূরা বাকারার এই ২ নং আয়াতটি ঠিক এই কথাটিই বলছে।

যদিও কুরআন সমগ্র মানবজাতির জন্য অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু আল্লাহ্‌ শুরুতেই স্পস্ট করে দিচ্ছেন যে, এই কিতাব থেকে পথনির্দেশনা বা হেদায়াত তারাই লাভ করবে, যারা ‘মুত্তাকী’। কারণ তারাই আপনার বর্ণনার মতো— * একে সাধারণ কথা হিসেবে নেয় না। * এর মূল্য সম্পর্কে সচেতন। * উপদেশ গ্রহণের মানসিকতা রাখে। * সন্দেহমুক্ত ঘোষণা:

মুত্তাকির সংজ্ঞা কি? মুত্তাকী কে বা কারা?

■  এটি সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শক।  সূরা আল-বাকারাহ, ২:১-২

মুত্তাকীর সংজ্ঞা: আয়াত ৩৯:৩৩, ২:১৭৭

■  আর যে সত্য নিয়ে এসেছে  এবং সেটাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই মুত্তাকী। সূরা আয যুমার৩৯:৩৩: 

🔗 আয়াত লিংক (৩৯:৩৩): (একমাত্র সত্যের উৎস: আল্লাহ নিজেই "আল-হক্ব" (সত্য রব) এবং তাঁর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া কুরআনও "আল-হক্ব" বা পরম সত্য (১০:৩২, ১৩:১, ৪৭:২), সত্যের আগমনে মিথ্যা বিলুপ্ত হতে বাধ্য-১৭:৮১),  সত্যকে গ্রহণ করার পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা কেবলই বিভ্রান্তি (১০:৩২)। এটি নিজেকে একমাত্র নির্ভুল ও চিরন্তন ঐশী গ্রন্থ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং সকল প্রকার মানবসৃষ্ট মতবাদকে বাতিল ঘোষণা করে (১৭:৮১, ১৩:১, ১০:৩২)।

💖 মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী: 💖

আল  কুরআনে আল্লাহ তা'আলা সেই সৌভাগ্যবান বান্দাদের কথা বলেছেন, যাদের জন্য তিনি প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা এবং আকাশ ও পৃথিবীর সমান প্রশস্ত জান্নাত। তারাই হলেন মুত্তাকী। সূরা আল-বাকারাহ এবং সূরা আলে ইমরানের এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ নিজেই তাঁদের অসাধারণ গুণাবলীর বর্ণনা দিয়েছেন।

আসুন, কুরআনের আলোকে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নিই।

মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী:

ঈমান ও বিশ্বাস:

পূর্ণাঙ্গ ঈমান: তারা আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, সকল আসমানি কিতাব এবং নবীগণের ওপর দৃঢ় ও  বিশ্বাস স্থাপন করে। (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৭৭)

ইবাদত ও আর্থিক ত্যাগ:

সর্বাবস্থায় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়: তারা সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা, অর্থাৎ সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করে। (সূরা আলে ইমরান ৩:১৩৪)

সম্পদের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও দান: 

নিজের সম্পদের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তারা তা নিকটাত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকিন, পথিক, সাহায্যপ্রার্থী এবং দাসমুক্তির জন্য ব্যয় করে। (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৭৭)

সালাত ও যাকাত: তারা নিয়মিত ও নিষ্ঠার সাথে সালাত প্রতিষ্ঠা করে (অহীর সংযোগ স্থাপন অনুশীল বা চর্চা করে) এবং নিজকে পরিশুদ্ধ করে। (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৭৭)

চারিত্রিক গুণাবলি ও সামাজিক আচরণ:

ক্রোধ সংবরণ করা: তারা নিজেদের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কোনো অন্যায় করে না। (সূরা আলে ইমরান ৩:১৩৪)

মানুষকে ক্ষমা করা: তারা মানুষের ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমা করে দেয়, প্রতিশোধপরায়ণ হয় না। (সূরা আলে ইমরান ৩:১৩৪)

ন্যায়বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা:  (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৮): 

সত্যবাদিতা অবলম্বন করা: সর্বদা সত্য কথা বলা এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকা। (সূরা আত-তাওবা, ৯:১১৯)

অঙ্গীকার পূর্ণ করা: যখন তারা কারো সাথে কোনো বিষয়ে অঙ্গীকার করে, তখন তা পরিপূর্ণভাবে পালন করে। (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৭৭)

কঠিন সময়ে ধৈর্যধারণ করা: তারা অভাব, অসুস্থতা এবং যুদ্ধের মতো কঠিন ও সঙ্কটময় মুহূর্তে ধৈর্যধারণ করে। (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৭৭, 3:134)

আল্লাহ তা'আলা এই গুণাবলীর অধিকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, "ওরাই তারা, যারা সত্য বলে এবং তারাই মুত্তাকী।" (২:১৭৭) এবং "আর আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালবাসেন।" (৩:১৩৪)

💖 প্রকৃত মুত্তাকী কারা? আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের চিনে নিন 💖

সূরা আল-ফুরকান (৬৩-৭৬):

পবিত্র কুরআনের সূরা আল-ফুরকানে আল্লাহ তা'আলা তাঁর কিছু বিশেষ ও প্রিয় বান্দার পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁদেরকে ‘ইবাদুর রাহমান’ বা ‘দয়াময়ের বান্দা’ বলে সম্বোধন করেছেন। এরাই হলেন প্রকৃত মুত্তাকী, যাদের গুণাবলী অর্জন করা প্রত্যেক মুমিনের স্বপ্ন।

আসুন, সেই সৌভাগ্যবান বান্দাদের বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নিই এবং নিজেদের জীবনে তা ধারণ করার চেষ্টা করি।

‘ইবাদুর রাহমান’ (দয়াময়ের বান্দা)-এর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী:

১. নম্র ও বিনয়ী: তারা পৃথিবীর বুকে অত্যন্ত নম্র ও শান্তভাবে চলাফেরা করে। তাদের আচরণে কোনো অহংকার বা ঔদ্ধত্য থাকে না। (আয়াত ৬৩)

২. অজ্ঞদের সাথে প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণ: যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা তাদের সাথে তর্কে জড়াতে চায়, তখন তারা বিবাদে না জড়িয়ে প্রজ্ঞার সাথে "সালাম" (শান্তি) বলে এড়িয়ে যায়। (আয়াত ৬৩)

৩. রাত্রি জাগরণ ও ইবাদত: তারা রাতের গভীরে তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য সিজদারত ও দণ্ডায়মান অবস্থায় (সালাতে) কাটায়। (আয়াত ৬৪)

৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি কামনা: তারা আল্লাহর কাছে জাহান্নামের ভয়াবহ ও চিরস্থায়ী শাস্তি থেকে আশ্রয় চেয়ে প্রতিনিয়ত দু'আ করে। (আয়াত ৬৫-৬৬)

৫. ব্যয়ের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা: সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে তারা ভারসাম্য রক্ষা করে। অপচয়ও করে না, কৃপণতাও করে না, বরং উভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে। (আয়াত ৬৭)

৬. শিরক, হত্যা ও ব্যভিচার থেকে মুক্ত: তারা একনিষ্ঠভাবে কেবল আল্লাহর ইবাদত করে, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার থেকে পবিত্র থাকে। (আয়াত ৬৮)

৭. তওবা ও আত্মশুদ্ধি: কোনো পাপ হয়ে গেলে তারা সাথে সাথে আন্তরিকভাবে তওবা করে, ঈমানকে নবায়ন করে এবং সৎকর্মে মনোনিবেশ করে। আল্লাহ তাদের পাপগুলোকে পুণ্য দ্বারা পরিবর্তন করে দেন। (আয়াত ৭০-৭১)

৮. মিথ্যা ও অনর্থক বিষয় পরিহার: তারা কখনো মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং কোনো অনর্থক বা অহেতুক কাজের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় আত্মমর্যাদার সাথে তা এড়িয়ে চলে। (আয়াত ৭২)

৯. আল্লাহর উপদেশ গ্রহণ করা: যখন তাদের সামনে কুরআনের আয়াত দিয়ে উপদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা অন্ধ বা বধিরের মতো আচরণ না করে মনোযোগ দিয়ে শোনে ও শিক্ষা গ্রহণ করে। (আয়াত ৭৩)

১০. উত্তম পরিবার ও মুত্তাকীদের নেতা হওয়ার জন্য দু'আ: তারা নিজেদের জীবনসঙ্গী ও সন্তানদের জন্য দু'আ করে, যেন তারা সৎকর্মশীল ও নয়নপ্রীতিকর হয়। এর পাশাপাশি তারা নিজেদেরকে মুত্তাকীদের জন্য ইমাম বা আদর্শ নেতা বানানোর জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। (আয়াত ৭৪)

তাদের জন্য পুরস্কার (আয়াত ৭৫-৭৬):

এই মহান গুণাবলী অর্জনে ধৈর্যধারণ করার প্রতিদান হিসেবে, আল্লাহ তাঁদেরকে জান্নাতের সুউচ্চ কক্ষ দান করবেন। সেখানে তাঁদেরকে অভিবাদন ও সালাম দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে। তাঁরা সেখানে চিরস্থায়ীভাবে থাকবেন। আর তা কতই না উত্তম আবাসস্থল!

২. বৈশিষ্ট্য ও কর্মগত বৈপরীত্য:

আয়াতগুলো থেকে মুত্তাকীর গুণাবলীর বিপরীতে থাকা বৈশিষ্ট্য ও কর্মগুলো নিচে একটি তুলনামূলক ছকে দেখানো হলো: 

মুত্তাকীর গুণাবলী (আপনার প্রদত্ত আয়াত অনুসারে)	এর বিপরীত বৈশিষ্ট্য (আপনার প্রদত্ত আয়াত অনুসারে)
১. আল্লাহ-সচেতন ও আল্লাহকে ভালবাসে/ তাঁর শাস্তিকে ভয় করে (اتَّقِ اللَّهَ) (২:২০৬, ৫:২, ৬৫:২, ৫৯:১৮)	১. আল্লাহকে ভুলে যায় এবং উপদেশ অগ্রাহ্য করে (৫৯:১৯)। যখন বলা হয় 'আল্লাহকে ভয় কর', তখন অহংকারবশত পাপে লিপ্ত হয় (২:২০৬)।
২. দান করে এবং সৎকর্মে সহযোগিতা করে (৯২:৫, ৫:২)	২. কৃপণতা করে এবং পাপ ও শত্রুতায় সহযোগিতা করে (৯২:৮, ৫:২)।
৩. উত্তমকে (দ্বীন/জান্নাত) সত্য বলে বিশ্বাস করে (৯২:৬)	৩. উত্তমকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে (৯২:১০)।
৪. ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে (৩৮:২৮)	৪. পৃথিবীতে ফাসাদ (বিপর্যয়) সৃষ্টি করে (৩৮:২৮)।
৫. আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখে (يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ) (৬৫:৩)	৫. নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে (اسْتَغْنَىٰ) (৯২:৮)। অর্থাৎ আল্লাহর ওপর ভরসা না করে নিজের সামর্থ্যের ওপর অহংকার করে।
৬. আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি নেয় (৫৯:১৮)	৬. পার্থিব জীবনকেই সুশোভিত ও আকর্ষণীয় মনে করে (২:২১২)।
৭. বিনয়ী ও উপদেশ গ্রহণকারী (তাকওয়ার অন্তর্নিহিত অর্থ)	৭. অহংকারী এবং ঈমানদার ও মুত্তাকীদের উপহাসকারী (২:২০৬, ২:২১২)।

 সারসংক্ষেপ: মুত্তাকীর বিপরীত চরিত্র:

আপনার উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে অনুধাবন করা যায় যে, মুত্তাকীর বিপরীত চরিত্রটি কেবল একটি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ নেতিবাচক প্রোফাইল। সেই চরিত্রটি হলো:

সে ফুজ্জার (পাপিষ্ঠ), ফাসিক (অবাধ্য) এবং কাফির (অবিশ্বাসী)। তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অহংকার, যা তাকে সত্য গ্রহণে বাধা দেয়। সে কৃপণ, আল্লাহর ওপর ভরসা করার পরিবর্তে নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে। সে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, আখিরাতের বদলে পার্থিব জীবন নিয়ে মোহাচ্ছন্ন থাকে এবং যারা ঈমানদার ও মুত্তাকী, তাদের উপহাস করে। সবচেয়ে বড় কথা, সে আল্লাহকে ভুলে যায়, ফলে আল্লাহও তাকে আত্মবিস্মৃত করে দেন।

জ্ঞানীরা ও চিন্তাভাবনা করতে পারা মানুষরাই যে সজাগ-সতর্ক-সচেতন (মুত্তাকি) হয় সে কথাও বলে দেওয়া হলো:

২:১৭৯ …..হে বোধসম্পন্নরা! (يّٰٓاُولِى الْاَلْبَابِ)! আশা করা যায় তোমরা সজাগ-সতর্ক-সচেতন হবে (لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ)! / যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করো।  সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯০-১৯১

কীভাবে এমন সজাগ-সচেতন চিন্তাভাবনা করতে পারা মানুষ তৈরি করা যাবে? তার উত্তরও আছে প্রথম সুরাতেই: 

২:১৮৩ ওহে যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের উপর আস-সিয়াম (الصِّيَامُ) জোরালো তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ দেওয়া হয়েছে (كُتِبَ) যেমন জোরালো তাড়না-প্রেরণা (كُتِبَ) করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর- যাতে তোমরা সচেতন (تَتَّقُونَ) হও। 

যথাযথ সঠিক কর্ম, ন্যায়পরায়ণতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর সুবহানাহু তা’লার অজুহাত দিয়ে শপথকে বাধা বানানো উচিত নয়। যেমন:

২:২২৪ আর তোমরা তোমাদের ভাল কাজে এবং তাকওয়া অবলম্বনে এবং মানুষের মাঝে মীমাংসায়, তোমাদের শপথগুলোর জন্য আল্লাহকে অজুহাত বানিও না। আর আল্লাহ সর্বস্পন্দনগ্রাহী, বিস্তৃত জ্ঞানসম্পন্ন।

2:185, 2:187: রমাদান মাস সেটাই, যার মধ্যে নাযিল করা হয়েছে কুরআন, মানুষের জন্য হিদায়েত এবং সঠিক পথের ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীর সুস্পষ্ট বর্ণনা স্বরূপ। অতএব, যে তোমাদের মধ্যে মাসটিতে উপস্থিত হবে সে যেন তাতে সওম পালন করে-2:185 . . . . সেসব আল্লাহর সীমারেখা। অতএব, তোমরা এর কাছে যেও না। ওভাবেই আল্লাহ মানুষের জন্য তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেন, যেন তারা তাকওয়া অর্জন করে। 

2:179: …আর ঘরসমূহে সেগুলোর পেছন দিক দিয়ে প্রবেশ করায় তোমাদের পুণ্য নেই। বরং পুণ্য হলো তার, যে তাকওয়া অর্জন করে। আর তোমরা গৃহসমূহে এর দরজাগুলো দিয়ে প্রবেশ করো। এবং আল্লাহ সচেতন হও, যেন তোমরা সফল হও।

মুত্তাকী-তাকওয়া মানে সজাগ-সতর্ক-সচেতন মানুষ? প্রমাণ: 

গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে 'মুত্তাকী'-এর বিপরীত বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রগুলো অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। কেবলমাত্র এই আয়াতগুলোর আলোকে, মুত্তাকীর বিপরীত ধারণাটি নিচে ধাপে ধাপে উপস্থাপন করা হলো:

১. সরাসরি বিপরীতার্থক শব্দ:

আপনার দেওয়া আয়াতগুলোতেই মুত্তাকীর সরাসরি বিপরীতার্থক কিছু শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে:

ফুজ্জার (الْفُجَّارُ): এই শব্দটি মুত্তাকীর সরাসরি বিপরীত হিসেবে সূরা সা-দ-এ উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ হলো পাপিষ্ঠ, সীমালঙ্ঘনকারী বা দুরাচার।

"অথবা মুত্তাকীদের আমরা কি ফুজ্জারদের (পাপিষ্ঠদের) মতো গণ্য করব?" (৩৮:২৮)

ফাসিক (الْفَاسِقُونَ): যারা আল্লাহকে ভুলে যায়, তাদের 'ফাসিক' বা অবাধ্য বলা হয়েছে। এটি তাকওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত একটি অবস্থা।

"...যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল, ফলে আল্লাহ তাদের নিজেদের সত্তাকে ভুলিয়ে দিয়েছেন। তারাই হল ফাসিক (অবাধ্য) জাতি।" (৫৯:১৯)

কাফির (الَّذِينَ كَفَرُوا): যারা অবিশ্বাস করে, তাদের পার্থিব জীবনকে আকর্ষণীয় মনে হয় এবং তারা মুত্তাকীদের উপহাস করে। এখানে তাকওয়ার বিপরীতে কুফর বা অবিশ্বাসকে স্থাপন করা হয়েছে।

"যারা অবিশ্বাস করে (কাফির) তাদের পার্থিব জীবন সুশোভিত করা হয়েছে, আর তারা উপহাস করে তাদের, যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে..." (২:২১২, ৩৩:১)

মুনাফিক: আয়াত ৩৩:১

তাকওয়া (تقوى) কাকে বলে?

তাকওয়া (تقوى) শব্দের অর্থ বিরত থাকা, বেঁচে থাকা, নিষ্কৃতি লাভ করা, নিজেকে রক্ষা করা, সতর্ক হওয়া। ব্যবহারিক অর্থে: আত্মশুদ্ধি , আল্লাহ ও সত্যের প্রতি সচেতন/ be aware of/ conscious থাকা। এবং পরিজ্ঞাত হওয়া, সহনশীলতা ইত্যাদি বোঝায়। 

🔗স্রষ্টা-সচেতন হওয়াই ইত্তাকুল্লাহ (وَاتَّقُوا اللّٰهَ) ২:১৮৯, 2:১৯৪, 2:২০৩, 2:২০৬।  সজাগ-সতর্ক-সচেতন হওয়া-7:35, 2:48, 2:123

🔗'তাকওয়া'র মূল অর্থ 'ভয়'-এর চেয়েও বেশি কিছু, বরং এটি এক প্রকার গভীর 'সচেতনতা', 'সতর্কতা' এবং 'সজাগ থাকা' 

১. আল্লাহ্‌র বিধান ও উপদেশের প্রতি সচেতনতা

মুত্তাকীরা আল্লাহ্‌র বাণী ও বিধানের ব্যাপারে অত্যন্ত মনোযোগী এবং সচেতন। তারা একে সাধারণ কথা হিসেবে নেয় না, বরং জীবন পরিচালনার গাইডলাইন হিসেবে গ্রহণ করে।

উপদেশ গ্রহণের যোগ্যতা: কুরআনকে "মানুষের জন্য সুস্পষ্ট বর্ণনা এবং মুত্তাকীদের জন্য হেদায়েত ও উপদেশ" বলা হয়েছে (৩:১৩৮)। এর মানে হলো, যাদের মধ্যে 'তাকওয়া' বা সচেতনতা আছে, তারাই এই উপদেশ থেকে প্রকৃত শিক্ষা নিতে পারে। একই কথা বলা হয়েছে (২৪:৩৪) এবং (১৯:৯৭)-এ, যেখানে মুত্তাকীদের সুসংবাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, কারণ তারাই এই বাণীর মূল্য সম্পর্কে সচেতন।

আইন-কানুন পালনে সতর্কতা: ওসিয়ত (২:১৮০) এবং ঋণ লিপিবদ্ধ করার (২:২৮২) মতো সুনির্দিষ্ট আইনি নির্দেশনার সাথে তাকওয়ার উল্লেখ প্রমাণ করে যে, মুত্তাকী ব্যক্তি এই বিধানগুলো পালনে অত্যন্ত সতর্ক ও সচেতন, যাতে কোনো অবিচার না হয়।

আল্লাহ্‌র আদেশের প্রতি সজাগ থাকা: যখন আল্লাহ্‌র অবাধ্য হতে বলা হয়, তখন মুত্তাকী তার ভেতরের সচেতনতার কারণে তা প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু যার মধ্যে তাকওয়া নেই, তাকে "আল্লাহকে ভয় কর" (২:২০৬) বললে তার অহংকার তাকে পাপে লিপ্ত করে, কারণ সে পরিণামের ব্যাপারে অসচেতন।

২. পরিণাম ও প্রতিফলের প্রতি সচেতনতা (Awareness of Consequences)

মুত্তাকীরা শুধু বর্তমান নিয়ে ভাবে না, তারা তাদের প্রতিটি কাজের চূড়ান্ত পরিণাম সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকে।

আখিরাতের প্রস্তুতি: আল্লাহ্‌ মুমিনদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, "প্রত্যেক ব্যক্তি যেন লক্ষ্য করে যে, সে আগামীকালের জন্য কী প্রেরণ করেছে" (৫৯:১৮)। এই 'লক্ষ্য করা' বা পর্যবেক্ষণই হলো সচেতনতা। মুত্তাকী সব সময় তার আখিরাতের হিসাব নিয়ে সচেতন থাকে।

চূড়ান্ত সাফল্যের জ্ঞান: বারবার বলা হয়েছে, "শুভ পরিণাম তো মুত্তাকীদের জন্যই" (৭:১২৮, ১১:৪৯)। এর অর্থ হলো, মুত্তাকীরা এমনভাবে জীবনযাপন করে কারণ তারা এই চূড়ান্ত সত্য সম্পর্কে সচেতন যে, আল্লাহকে মেনে চলার মধ্যেই প্রকৃত ও স্থায়ী সাফল্য নিহিত।

আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয়: "আর তোমরা সেই দিন সম্পর্কে সতর্ক হও, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর কাছে ফিরিয়ে আনা হবে" (২:২৮১)। এই আয়াতটি সরাসরি 'সতর্ক' বা 'সচেতন' হওয়ার কথা বলছে, যা তাকওয়ার মূল ভিত্তি।

৩. সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্বের প্রতি সচেতনতা

তাকওয়া শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রেও এক ধরনের প্রখর সচেতনতা।

প্রতিশ্রুতি পালনে সতর্কতা: মুত্তাকীরা তাদের চুক্তি ও অঙ্গীকারের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। আল্লাহ বলেন, "নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন" যারা তাদের চুক্তি পূর্ণ করে (৩:৭৬, ৯:৪, ৯:৭)।

ন্যায়ের পক্ষে থাকা:  "আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকীদের পক্ষ থেকেই কবুল করেন" (৫:২৭)। এটি প্রমাণ করে, তিনি সচেতন ছিলেন যে, আল্লাহ কেবল বাহ্যিক আমল দেখেন না, বরং ভেতরের নিষ্ঠা ও আল্লাহ-সচেতনতা দেখেন।

৪. উদাসীনতা ও অজ্ঞতার বিপরীত অবস্থা

আপনার দেওয়া আয়াতগুলো থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ পাওয়া যায় যখন মুত্তাকীদেরকে উদাসীন (গাফিল) মানুষদের বিপরীতে উপস্থাপন করা হয়।

প্রকাশ্য বনাম বাস্তবতার জ্ঞান: আল্লাহ বলেন, "তারা পার্থিব জীবনের প্রকাশ্য দিক সম্পর্কে জানে, আর আখিরাত সম্পর্কে তারা একেবারেই উদাসীন (غَافِلُونَ)" (৩০:৭)। এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে দেখায় যে, তাকওয়া হলো 'গাফলাত' বা উদাসীনতার সম্পূর্ণ বিপরীত। মুত্তাকী ব্যক্তিরা জীবনের বাহ্যিক চাকচিক্যের আড়ালে থাকা আসল বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন।

উপহাসকারী বনাম দূরদর্শী: কাফিররা, যারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে ব্যস্ত, তারা মুত্তাকীদের উপহাস করে। কিন্তু আল্লাহ বলেন, "যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে, কিয়ামতের দিন তারা তাদের উপরে থাকবে" (২:২১২)। মুত্তাকীরা এই ভবিষ্যৎ মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন, তাই তারা কাফিরদের উপহাসে বিচলিত হয় না।

উপসংহার:

আপনার উল্লেখিত আয়াতগুলো থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, 'মুত্তাকী' হলেন সেই ব্যক্তি যিনি নিছক 'ভয়' করেন না, বরং এক প্রখর আল্লাহ-সচেতনতা (God-consciousness) নিয়ে জীবনযাপন করেন। এই সচেতনতা তাকে:

আল্লাহর বিধান পালনে সতর্ক করে তোলে।

নিজের কাজের পরিণাম সম্পর্কে সজাগ রাখে।

সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান করে।

উদাসীনতা ও দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্ত রাখে।

সুতরাং, আপনার বিশ্লেষণটি সম্পূর্ণরূপে সঠিক। মুত্তাকী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর ব্যাপারে সজাগ, সতর্ক এবং সচেতন থাকেন—তিনিই প্রকৃত 'God-conscious' বা আল্লাহ-সচেতন মানুষ।

শুধু তা-ই নয়, এমন সজাগ-সচেতন মানুষদের জন্যই মহাগ্রন্থ সহজ ও সুসংবাদ। 

১৯:৯৭ অতঃপর প্রকৃতপক্ষে আমি তোমার ভাষায় তা সহজ করেছি যাতে তুমি তা দিয়ে সুসংবাদ দাও (لِتُبَشِّرَ بِهِ) সজাগ-সচেতন লোকদের (ٱلْمُتَّقِينَ) আর তা দিয়ে ঝগড়াটে লোকেদেরকে হুঁশিয়ার/সতর্ক করো (تُنذِرَ)।

 

২৪:৩৪ আর নিঃসন্দেহে আমি অবতীর্ণ করেছি তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ (وَلَقَدْ اَنْزَلْنَآ اِلَيْكُمْ اٰيٰتٍ مُّبَيِّنٰتٍ) আর তোমাদের পূর্বে যারা অতীত হয়েছে তাদের দৃষ্টান্ত এবং শিক্ষামূলক সতর্কতা (مَوْعِظَةً) সজাগ-সচেতনদের জন্যে (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।

 

সজাগ-সতর্ক-সচেতন মানুষ? মহাগ্রন্থের শুরু থেকেই কিছু উদাহরণ:

২:১৮০ তোমাদের ওপর জোরালো তাড়না-প্রেরণা-উৎসাহ দেওয়া হয়েছে  (كُتِبَ عَلَيْكُمْ)- যখন তোমাদের কারও মৃত্যু (الْمَوْتُ) হাজির হয়, যদি সে কল্যাণ-সম্পদ (خَيْرًا) ছেড়ে যায়, তবে ন্যায্যভাবে ওসিয়াত করে (ٱلْوَصِيَّةُ–the will) পিতা-মাতা ও নিকট আত্মীয়ের জন্য, সজাগ-সচেতনদের জন্যে এটা যথাযথ কর্তব্য (حَقًّا عَلَى الْمُتَّقِيْن)।

7:26: হে বনী আদম! অবশ্যই আমরা তোমাদের প্রতি এমন পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থানগুলো ঢেকে রাখবে ও ভূষণস্বরূপ।  আর তাকওয়ার পোশাক, সেটাই উত্তম।  সেটা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্ভুক্ত, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে।

 

২:২৭৮ ওহে যারা বিশ্বাস করেছ! আল্লাহর বিষয়ে সচেতন হও এবং ছেড়ে দাও যা অবশিষ্ট আছে বর্ধিত সুদ (ٱلرِّبَوٰٓا۟) থেকে- যদি তোমরা বিশ্বাসী হও!

২:২৮১ সে সময়ের (يَوْمًا) বিষয়ে সতর্ক-সচেতন হও (اتَّقُوْا) যে-সময়ের মধ্যে প্রত্যাবর্তন হবে (تُرْجَعُونَ) আল্লাহর দিকে (اِلَى اللّٰهِ); তারপর প্রত্যেক আত্মাকে/ব্যক্তিকে (كُلُّ نَفْسٍ) তার অর্জন পরিপূর্ণ দেওয়া হবে (تُوَفَّىٰ) আর তাদের অন্যায়-অত্যাচার করা হবে না (وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ)।

 

৩:৭৬ হ্যাঁ, যে নিজ তার চুক্তি পূর্ণ করে ও সচেতন থাকে (بَلٰى مَنْ اَوْفٰى بِعَهْدِهٖ وَاتَّقٰى), অতঃপর নিশ্চয়ই আল্লাহ সজাগ-সচেতন লোকদের ভালোবাসেন (فَاِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ)।

 

৩:১৩৭,১৩৮ নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্বে বহু জীবনাচরণ/পরিস্থিতি (سُنَنٌ) পার হয়েছে, অতএব পৃথিবীতে ভ্রমণ কর (فَسِيْرُوْا فِى الْاَرْضِ) আর খেয়াল করো- মিথ্যাবাদীদের পরিণাম (عَاقِبَةُ الْمُكَذِّبِيْنَ) কেমন হয়েছে। এসব মানবজাতির জন্য বিবরণ (هٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ) ও পথনির্দেশ (هُدًى) এবং শিক্ষামূলক সতর্কতা (مَوْعِظَةً) সজাগ-সচেতনদের জন্যে (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।

 

পৃথিবীতে ভ্রমণ করে তথ্য অনুসন্ধান করা, বিক্ষিপ্ত সূত্র দেখে অতীত রহস্যময় ঘটনা উপলব্ধি করার কাজটি হয়ত রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের ফেলুদা বা শার্লক হোমস ভালো পারবে। তবে, বাস্তব জীবনে মানুষই তা পারে। বাস্তবজীবনেই বিচ্ছেদের পর সাবেক স্ত্রীকে যথাযথ ভরণ-পোষণ দেওয়া দুর্বল চেতনার মানুষের কাজ নয়। বরং, যার মধ্যে নিষ্ঠা, সতর্কতা, সচেতনতাবোধ সদা-জাগ্রত থাকে, সেসব মানুষই কঠিন পরিস্থিতিতেও সঠিক কাজ করতে পারে। এমনকি, কতটুকু বিচক্ষণ মানুষ হলে সে তার মৃত্যুর সময় সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। তখন সেই মানুষটিকে সহায়-সম্পদ ওসিয়ত করার দায়িত্ব-কর্তব্য দেওয়া হয়েছে (হাক্ব আলা আল-মুত্তাকিন)! তেমন মানুষই তো নিজের প্রতিশ্রুতি/চুক্তি পূর্ণ করার বিষয়ে সদা-সচেষ্ট ও সতর্ক থাকে! টনটনে সচেতন না হলে নিজেকে বিশ্বাসী বলে প্রমাণের জন্য চক্রবৃদ্ধি হারে বর্ধিত সুদের অর্থ ছেড়ে দিতে পারে কেউ?!? আর্থিক লেনদেন, ঋণ-ধারের বিষয়ে ঠিকঠাক লিখে রাখতে বলা হচ্ছে বোকাদের নয়, বরং সজাগ-সচেতন বুদ্ধিমান লোকদেরকেই (২:২৮২,২৮৩)।

এমন মুত্তাকি বা সতত সচেতন ও জাগ্রত চেতনার নারী-পুরুষদের মহান আল্লাহ খুব ভালো করেই জানেন (৩:১১৫); আর তাদেরকেই আসমান-জমিনের পরিধির সমান বিস্তৃত জান্নাতের দিকে ছুটে যেতে বলা হয়েছে (৩:১৩৮)। মহান আল্লাহ মুত্তাকিদের ত্যাগ (৫:২৭) গ্রহণ করেন, তাদেরকেই শুভ পরিণাম দেন (৭:১২৮)। এমন সজাগ-সচেতন মানুষগুলোই মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি সুচারুভাবে রক্ষা করে, যথাযথভাবে লড়াই-সংগ্রাম করে (৯:৪,৭,৩৬,৪৪,১২৩), ওহি-সূত্রে প্রাপ্ত গায়েবের জগতের বিষয়ে সবর অবলম্বন করে (১১:৪৯), তারা জগতেও কল্যাণ করবে, কল্যাণপ্রাপ্ত হবে; তাদের আখিরাতের আবাসও হবে উৎকৃষ্ট মানের (১৬:৩০,৩১)। এমন সজাগ-সচেতন মানুষ হবে মহান আল্লাহর কাছে সম্মানিত (১৯:৫৮, ৩৮:৪৯); আর মহান আল্লাহই মুত্তাকিদের পক্ষে থাকেন, তাদের রক্ষা করেন (৪৫:১৯)।

পরিশেষে, ৩:১০২ ওহে যারা বিশ্বাস করেছো! আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন হও (اتَّقُوا اللّٰهَ) যেভাবে তাঁর প্রতি যথাযথ সচেতন হতে হয় (حَقَّ تُقٰىتِهٖ); আর তোমরা আত্মসমর্পণকারী (اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ) না হয়ে মারা যেও না! 

 

যাবতীয় বিষয়ে সবকিছু জানেন ও খোঁজ রাখেন মহান আল্লাহ। সেই মহান রব্বুল আলামিনের বিষয়েই গোঁয়ারতুর্মি করে উদাসীন থাকলে, পরকালে সুনিশ্চিত অন্ধকার! তবে দুনিয়ার বিষয়ে সচেতন থাকার সুবাদে পৃথিবীতে সমৃদ্ধ জীবন পাবে। (২:২০৬ ও ২:২১২)

 

৩০:৭ তারা জানে দুনিয়ার জীবন থেকে প্রকাশ্য/বাহ্যিক দিক এবং তারা সেই পরজীবন (ٱلْءَاخِرَةِ) সম্পর্কে তারাই উদাসীন/অমনোযোগী (غَٰفِلُونَ)।

. . . . . . . . . . . . . . . . . . .

ভয়/আশঙ্কা/দুশ্চিন্তা বা ‘খওফ’ সংক্রান্ত আরো আয়াত: ২:৩৮, ৬২, ১১২, ১৫৫, ২৬২, ২৭৪, ২৭৭; ৩:১৭০; ৪:৮৩, ৫:৬৯, ৬:৪৮, ৭:৩৫, ৪৯, ৫৬; ১০:৬২, ৮৩; ১৩:১২, ১৬:১১২, ২৪:৫৫, ৩০:২৪, ৩২:১৬, ৩৩:১৯, ৪৩:৬৮, ৪৬:১৩, ১০৬:৪

এসব আয়াতের কোথাও আছে- বিদ্যুৎচমকের ভয়, ক্ষুধার কষ্টে পড়ার ভয়, দুর্যোগের ভয়…; যা মূলত দুঃখ-কষ্ট-আশঙ্কার ভয়।

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . 

যারা সজাগ-সচেতন মানুষ (মুত্তাকি), তারা দুনিয়ার জীবনের এহেন সংকট ও শঙ্কা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারেন।  আর যারা একই সঙ্গে সজাগ-সচেতন (মুত্তাকি) এবং মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী (আমানু-মু’মিন) তারা দুনিয়ার জীবন এবং আল-আখিরাতের কঠিন বিপদ-ভয়-আশঙ্কা থেকে রক্ষা পেতে পারেন।

আর তার পরিণাম হিসেবে সজাগ-সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) পাবে অফুরন্ত পুরস্কার- যা মহান আল্লাহর অফুরান দয়ার অংশমাত্র।

যেমন-

নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) থাকবে উদ্যান ও নির্ঝরিনীর মধ্যে (اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنّٰتٍ وَّعُيُوْنٍ) ১৫:৪৫

নিশ্চয়ই সজাগ সচেতন মানুষগুলো (الْمُتَّقِيْنَ) প্রাচুর্যের উদ্যানে (جَنّٰتٍ وَّنَعِيْمٍ)। (৫২:১৭)

 اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ جَنّٰتٍ وَّنَعِيْمٍۙ   ( الطور: ١٧ )

সেসময় (يَوْمَ) সজাগ-সচেতন মানুষগুলোকে সমবেত করবো আর-রহমানের কাছে প্রতিনিধি-স্বরূপ (وَفْدًا —delegations)-১৯:৮৫

এই হলো যিকর-উপদেশ (هٰذَا ذِكْرٌ); আর নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতন মানুষদের জন্য (لِلْمُتَّقِيْنَ) সুনিশ্চিত উৎকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল (لَحُسْنَ مَاٰبٍ)। ৩৮:৪৯

নিশ্চয়ই সজাগ-সচেতনরা (الْمُتَّقِيْنَ) নিরাপদ স্থানে (مَقَامٍ اَمِيْنٍ)। ৪৪:৫১

[اِنَّ الْمُتَّقِيْنَ فِيْ مَقَامٍ اَمِيْنٍۙ  ( الدخان: ٥١ )]

. . . . . . . . . . . . . . . . . . .

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ‘তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার সতর্ক-সচেতন মানুষ’  মানুষ কিন্তু অবিশ্বাসী বা স্রষ্টার বিষয়ে (স্বেচ্ছায়) অসচেতন বা অস্বীকারকারীও হতে পারে।

যেমন, বর্তমান বিশ্বের চরমপন্থি ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগুলোর প্রধান যারা, সেসব শাসকগোষ্ঠীর লোকজন খুব ভালো করেই জানে যে, কীভাবে মানুষের ওপর শোষণ বঞ্চনা চালাতে হয়। যেমন ধরুন, উত্তর কোরিয়া, চীন, ইরান এমনসব দেশের শাসকগোষ্ঠী শত বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মানুষকে বুদ্ধি, শক্তি, মেধা, অর্থ, অস্ত্র দিয়ে অন্ধ বানিয়ে রেখেছে। তারা কি নিরেট বোকা টাইপের মানুষ হতে পারে? অবশ্যই না। বরং, তারা প্রচণ্ড চতুর, কৌশলী, জাগতিক শিক্ষায় উন্নীত বুদ্ধিমান মানুষ। রাজনীতি, শাসননীতি ও সংশ্লিষ্ট খাতে তারা ‘তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসম্পন্ন সচেতন মানুষের’ কাতারেই পড়েন। তাহলে তারাও কি মুত্তাকী হয়ে যায় না? তারাও কি মুত্তাকি হওয়ার জন্য মহান রবের কাছে ‘মাগফিরাত ওয়া জান্নাত’ পেয়ে যাবে?

সাধারণ বিচারবোধ বলে, তেমনটি হবার কথা নয়। অথবা, মুত্তাকি সনাক্তকরণে কোথাও ভুল হয়েছে।

২:১০৩ আর যদি তারা বিশ্বাস করতো (اٰمَنُوْا) এবং সজাগ-সচেতন হতো (وَاتَّقَوْا) আল্লাহর নিকট থেকে সুনিশ্চিত কল্যাণকর (خَيْرٌ) পুরস্কার পেত।

০৫:০৮ ওহে যারা ঈমান এনেছো (يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)! আল্লাহর জন্য ন্যায্যভাবে (بِالْقِسْطِ) সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকো (قَوَّامِيْنَ لِلّٰهِ شُهَدَاۤءَ); আর বিদ্বেষ তোমাদের প্ররোচিত না করে (وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ) কোন জাতি/গোষ্ঠী/ সম্প্রদায়ের প্রতি (قَوْمٍ عَلٰٓى) যাতে তোমরা সুবিচার না করো (اَلَّا تَعْدِلُوْا); তোমরা সুবিচার কর (اِعْدِلُوْاۗ هُوَ)- তা সচেতনতার নিকটতর (اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰىۖ); আর আল্লাহ-সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ); নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোভাবেই অবহিত- তোমরা যা করো।

 

০৫:১১ ওহে যারা ঈমান এনেছো ( اٰمَنُوا)! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর (اذْكُرُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ) যখন এক সম্প্রদায় তোমাদের দিকে হাত বাড়াতে চেয়েছিল তখন তিনি তাদের হাত তোমাদের থেকে নিবৃত্ত করেছিলেন; আর তোমরা আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ); আল্লাহর উপরেই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত (وَعَلَى اللّٰهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ)। 

০৫:৫৭ ওহে যারা ঈমান এনেছো (يٰٓاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا)! গ্রহণ করো না- যারা তোমাদের দীন/জীবনব্যবস্থা-কে তামাশা ও খেলার বিষয় রূপে ( هُزُوًا وَّلَعِبًا) গ্রহণ করে- যাদেরকে তোমাদের পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে থেকে ও কাফেরদেরকে অভিভাবক-রূপে (أَوْلِيَآءَۚ); আর আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰ) যদি তোমরা বিশ্বাসী (مُّؤْمِنِينَ) হও। 

৫:৬৫ আর যদি আল-কিতাবের অধিকারীরা বিশ্বাস করতো ও সজাগ-সচেতন হতো (اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْ) অবশ্যই মুছে দিতাম (لَكَفَّرْنَا) তাদের থেকে তাদের দোষগুলো এবং আমি তাদের প্রবেশ করাতাম সেই সমৃদ্ধির উদ্যানে (جَنّٰتِ النَّعِيْمِ)।

৭:৯৬ জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস করতো ও সজাগ-সচেতন হতো (اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا) তাহলে আমি তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দ্বারসমূহ (بَرَكٰتٍ مِّنَ السَّمَاۤءِ وَالْاَرْضِ) খুলে দিতাম, কিন্তু তারা  মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করলাম তাদের কৃতকর্মের কারণে।

১২:৫৭ তাদের জন্য সেই পরজীবনের (الْاٰخِرَةِ ) পুরস্কারই উত্তম- যারা বিশ্বাস করে (لِّلَّذِيْنَ اٰمَنُوْا) এবং তারা সজাগ-সচেতন থাকে (وَكَانُوْا يَتَّقُوْنَ)।

১৬:৩০ আর যারা সজাগ-সচেতন ছিল তাদেরকে বলা হবে তোমাদের রব কি নাযিল করেছিলেন? তারা বলবে- কল্যাণ; যারা এই দুনিয়ায় ভালো করবে তাদের জন্য ভালোই আর আখিরাতের বাসস্থান কল্যাণময়; আর সজাগ-সচেতন মানুষের আবাস সুনিশ্চিত চমৎকার।

৪৯:১ ওহে যারা বিশ্বাস করো (ءَامَنُوا۟)! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সামনে অগ্রগামী হয়ো না আর আল্লাহ সচেতন হও (وَاتَّقُوا اللّٰهَ ); নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞানী (سَمِيْعٌ عَلِيْمٌ )।

৪৭:৩৬ নিশ্চয়ই দুনিয়ার জীবন (الْحَيٰوةُ الدُّنْيَا) খেলা ও অর্থহীন আনন্দের (لَعِبٌ وَّلَهْوٌ); আর যদি তোমরা বিশ্বাস করো ও সজাগ-সচেতন হও (تُؤْمِنُوْا وَتَتَّقُوْا), তিনি তোমাদের পুরস্কার দেবেন (يُؤْتِكُمْ اُجُوْرَكُمْ), আর তিনি তোমাদের সম্পদ চান না (وَلَا يَسْـَٔلْكُمْ اَمْوَالَكُمْ)।

পরিশেষে-

৬:৩২ এই দুনিয়ার জীবন (الْحَيٰوةُ الدُّنْيَآ) শুধুমাত্র খেলা ও অর্থহীন আনন্দের (اِلَّا لَعِبٌ وَّلَهْوٌ) এবং পরজীবনের সেই বাসস্থান উৎকৃষ্ট- তাদের জন্য যারা সজাগ-সতর্ক-সচেতন (لِّلَّذِيْنَ يَتَّقُوْنَ); তাহলে কি যুক্তি-বোধ খাটাবে না (اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ)?

৩:১৩৮ এটা বর্ণনা (بَيَانٌ) মানবজাতির জন্য (لِّلنَّاسِ) এবং দিক-নির্দেশনা ও বিশেষ উপদেশ (মাওইজাতুন- مَوْعِظَةٌ) সজাগ-সচেতনদের জন্য (لِّلْمُتَّقِيْنَ)।

৬:১৫৫ আর এই গ্রন্থ (وَهٰذَا كِتٰبٌ) আমি তা নাযিল করেছি (اَنْزَلْنٰهُ) কল্যাণময় (مُبٰرَكٌ); অতএব তারই অনুসরণ করো (فَٱتَّبِعُوهُ) এবং সজাগ-সচেতন হও, যাতে তোমরা দয়া লাভ করো (لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ)।

📌তাকওয়া/ মুত্তাকী হতে চেয়ে  ও বোধসম্পন্নদের মতো চিন্তা করতে চান, তাহলে এই আয়াতগুলো নিয়মিত পাঠে এবং দুআ/যিকির তাসবিহ/ প্রার্থনা করতে পারেন একমাত্র রবের দেয়া ভাষায় এভাবে-  (দ্র: দুআ লিংক: আয়াত ৩:১৯৮, ৩৮:২৮, ৫:২, ২:১৯৮, ২:১৮৩, ৫৯:১৮, 7:35, ২:১৭৭)।  

 আল-কুরআনের আলোকে তাকওয়ার পূর্ণাঙ্গ পথচিত্র

১. সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য: একনিষ্ঠ ইবাদত

• মূল আয়াত: "আমি জিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।" (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:৫৬)

• শিক্ষা: আমাদের অস্তিত্বের প্রধান লক্ষ্য হলো আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ দাসত্ব ও উপাসনা।

• আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আয়াত:

  • একনিষ্ঠতার নির্দেশ: "তাদেরকে এছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে।" (সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, ৯৮:৫) — এই আয়াতটি ইবাদতের সাথে ‘ইখলাস’ বা একনিষ্ঠতার গুরুত্বকে অপরিহার্য করে দেয়।

  • সকল নবীর আহ্বান: "আর আমি তোমার পূর্বে এমন কোনো রাসূল পাঠাইনি যার প্রতি আমি এই ওহী অবতীর্ণ করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো’।" (সূরা আল-আম্বিয়া, ২১:২৫) — এটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহর ইবাদতই ছিল সকল যুগে মানবজাতির জন্য একমাত্র নির্দেশনা।

২. ইবাদতের চূড়ান্ত লক্ষ্য: তাকওয়া অর্জন

• মূল আয়াত: "হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই রবের ইবাদত করো, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।" (সূরা আল-বাকারা, ২:২১)

• শিক্ষা: সকল ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা স্থাপন করে ‘তাকওয়া’ (আল্লাহ-সচেতনতা) অর্জন করা।

• আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আয়াত:

  • কিসাসের উদ্দেশ্য: "হে বুদ্ধিমানগণ! কিসাসের (প্রতিশোধের বিধান) মধ্যে তোমাদের জন্য জীবন রয়েছে, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো।" (সূরা আল-বাকারা, ২:১৭৯) — এটি দেখায় যে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ইবাদত নয়, বরং সামাজিক ন্যায়বিচারের বিধানগুলোও সমাজে তাকওয়া প্রতিষ্ঠার জন্য দেওয়া হয়েছে।

  • আল্লাহর আনুগত্য: "হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো, যেমনটা তাঁকে ভয় করা উচিত এবং মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।" (সূরা আলে-ইমরান, ৩:১০২) — এই আয়াত তাকওয়াকে জীবনের இறுதி মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণ করার নির্দেশ দেয়।

৩. তাকওয়া অর্জনের ব্যবহারিক উপায়
কুরআন আমাদের তাকওয়া অর্জনের জন্য ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্দেশনা দিয়েছে:

• সিয়াম (রোজা): "...যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো।" (সূরা আল-বাকারা, ২:১৮৩)

• শালীন পোশাক: "...আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম।" (সূরা আল-আ'রাফ, ৭:২৬)

• আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আয়াত:

  • ন্যায়বিচার ও সততা: "হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে দৃঢ় থাকো... তোমরা ন্যায়বিচার করো, তা তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটবর্তী।" (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৮) — তাকওয়া শুধু ইবাদতে নয়, মানুষের সাথে লেনদেন ও বিচারেও প্রকাশ পায়।

  • দান ও সদকা: "(জান্নাত) মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় দান করে..." (সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৩৩-১৩৪) — আল্লাহর পথে সম্পদ ব্যয় করা মুত্তাকীদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

  • সত্যবাদিতা: "হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো।" (সূরা আত-তাওবা, ৯:১১৯) — তাকওয়া ও সত্যবাদিতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

৪. তাকওয়ার সর্বোচ্চ পুরস্কার: আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাফল্য

• মূল আয়াত: "(হাবিল বলেছিল) আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকীদের থেকেই (আমল) কবুল করেন।" (সূরা আল-মায়িদা, ৫:২৭)

• শিক্ষা: আল্লাহর কাছে আমল কবুল হওয়াই মুমিনের চূড়ান্ত সফলতা, যা তাকওয়ার উপর নির্ভরশীল।

• আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আয়াত:

  • আল্লাহর ভালোবাসা: "নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের ভালোবাসেন।" (সূরা আলে-ইমরান, ৩:৭৬) — আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে বড় কোনো পুরস্কার হতে পারে না।

  • দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তি: "আর যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য বের হওয়ার পথ করে দেন এবং তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।" (সূরা আত-তালাক, ৬৫:২-৩) — তাকওয়া দুনিয়ার সংকট থেকে মুক্তি এবং বরকতময় জীবনের নিশ্চয়তা দেয়।

  • চিরস্থায়ী জান্নাত: "নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা থাকবে জান্নাতে ও ঝর্ণাধারার মাঝে।" (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:১৫) — তাকওয়ার চূড়ান্ত প্রতিদান হলো চিরশান্তির আবাস জান্নাত।

৫. তাকওয়ার মূল উৎস: আল-কুরআনের হিদায়াত

• মূল আয়াত: "এ সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য পথপ্রদর্শক (হিদায়াত)।" (সূরা আল-বাকারা, ২:২)

• শিক্ষা: তাকওয়া অর্জনের একমাত্র নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ সংবিধান হলো আল-কুরআন।

• আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আয়াত:

  • অন্তরের নিরাময়: "হে মানবজাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে উপদেশ, অন্তরের রোগের নিরাময়, হিদায়াত এবং মুমিনদের জন্য রহমত।" (সূরা ইউনুস, ১০:৫৭) — কুরআন শুধু পথ দেখায় না, বরং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে তাকওয়ার জন্য প্রস্তুত করে।

  • পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যায়ন: "(ঈসাকে) আমি ইনজিল দিয়েছিলাম, যাতে ছিল হিদায়াত ও আলো... এবং তা ছিল মুত্তাকীদের জন্য হিদায়াত ও উপদেশ।" (সূরা আল-মায়িদা, ৫:৪৬) — এটি প্রমাণ করে যে, ঐশী গ্রন্থগুলো সর্বদাই মুত্তাকীদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে।

সারসংক্ষেপ:

এই আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট যে, তাকওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন আমল নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এর সূচনা হয় সৃষ্টির উদ্দেশ্য উপলব্ধি করার মাধ্যমে, বিকশিত হয় ইবাদত ও উন্নত নৈতিকতার অনুশীলনে, যার চালিকাশক্তি হলো আল-কুরআনের হিদায়াত এবং যার চূড়ান্ত পুরস্কার হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাত।

অনলাইন সূত্র: https://app.proggamoyquran.com/, https://islamofquran.com/, https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE