"করদে হাসানা" কি? -একটি গভীরতর বিশ্লেষণ

আমরা 'করদে হাসানা'র প্রচলিত ধারনার একটু বাইরে গিয়ে হলেও কুরআনের আলোকে এর গভীর তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই বিষয়ে আপনাকেও গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার অনুরোধ রইল।


সাধারণভাবে "করদে হাসানা" বলতে লাভবিহীন ঋণ বা 'প্রফিট-ফ্রি লোন' বোঝানো হয়, যেখানে ঋণদাতা কোনো প্রকার লাভ বা সুদ ছাড়াই ঋণ প্রদান করেন। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় এই পরিভাষা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু কুরআন গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে 'করদে হাসানা'-এর অর্থ আরও ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ।




শব্দগত বিশ্লেষণ:

‘কর্দ’ (قَرْض) শব্দের একটি মূল অর্থ হলো ‘কর্তন করা’ বা ‘কেটে ফেলা’।

‘হাসানা’ (حَسَنَة) অর্থ ‘উত্তম’, ‘সুন্দরতম’ বা ‘সর্বোৎকৃষ্ট’।

সুতরাং, ‘করদে হাসানা’-এর একটি গভীরতর অর্থ দাঁড়ায় ‘উত্তমরূপে কর্তন করা’ বা ‘সুন্দরতম রূপে বিলিয়ে দেওয়া’।


কুরআনের আলোকে অনুধাবন:

সূরা আল-বাকারাহ (২:২৪৫):

"কে সেই ব্যক্তি যে আল্লাহকে ‘করদে হাসানা’ (উত্তম ঋণ) দেবে? অতঃপর আল্লাহ তাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন। আর আল্লাহই সংকুচিত করেন ও প্রশস্ত করেন এবং তাঁরই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।"


এখানে প্রশ্ন হলো, আল্লাহ কি ঋণের মুখাপেক্ষী? নিশ্চয়ই নন। বরং এর অর্থ হলো, আল্লাহর জন্য সর্বোত্তম পন্থায় নিজেকে, নিজের সম্পদ ও সময়কে উৎসর্গ করা, বিলিয়ে দেওয়া। আল্লাহ এই ত্যাগকে বহুগুণে বাড়িয়ে ফেরত দেবেন।


প্রচলিত ঋণের ধারণা বনাম কুরআনিক তাৎপর্য:

সূরা বাকারার ২৮২ নং আয়াতে সাধারণ ঋণ বা দেনা-পাওনার বিষয়ে বিশদ আলোচনা আছে, যেখানে "দাইন" (دَيْن) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু "করদে হাসানা" একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বহন করে।

"করদে হাসানা" মানে শুধু অর্থ ঋণ দেওয়া নয়, বরং আল্লাহর জন্য নিজের সবকিছুকে ‘কেটে’ বা পৃথক করে সর্বোত্তমভাবে উৎসর্গ করা।

সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও উৎসর্গ:

এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অন্যান্য আয়াতে, যেমন:

সূরা আন-নিসা (৪:৭৫): আল্লাহর পথে লড়াই করার আহ্বান।

সূরা আল-বাকারাহ (২:২০৭): (বক্তব্যে সম্ভবত এই আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যদিও ২০৫ বলা হয়েছে) যেখানে বলা হয়েছে, "আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজ জীবনকে বিক্রয় করে দেয়।"

সূরা আল-মুলক (৬৭:২): "...যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, তোমাদের মধ্যে কে আমলে সর্বোৎকৃষ্ট (আহসানু আমালা)।" ‘করদে হাসানা’ এই সর্বোৎকৃষ্ট আমলেরই একটি অংশ।

আল্লাহর সাথে চুক্তি ও তার প্রতিদান:

সূরা আল-মায়িদাহ (৫:১২): এখানে আল্লাহ বনী ইসরাঈলের সাথে চুক্তির কথা বলছেন, যেখানে সালাত কায়েম, যাকাত প্রদান এবং আল্লাহর রাসূলগণের প্রতি ঈমান ও সাহায্য করার পর বলা হয়েছে, "...এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ (করদে হাসানা) দেবে।" এর প্রতিদানে পাপ মোচন ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

সূরা আল-হাদীদ (৫৭:১১ এবং ১৮): "কে সে, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেবে, ফলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক প্রতিদান?" (১১)। "নিশ্চয় দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী এবং যারা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দেয়, তাদের প্রতিদান বহুগুণ বৃদ্ধি করা হবে এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।" (১৮)

সূরা আত-তাগাবুন (৬৪:১৭): "যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তিনি তা তোমাদের জন্য বহুগুণ বৃদ্ধি করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন।"

সূরা আল-মুযযাম্মিল (৭৩:২০): "...আর আল্লাহকে দাও উত্তম ঋণ।"


উপসংহার:

"করদে হাসানা" শুধুমাত্র একটি আর্থিক লেনদেন বা সুদবিহীন ঋণ নয়। এটি একটি ব্যাপক ইসলামী পরিভাষা, যার অর্থ হলো:

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের জীবন, সম্পদ, সময়, শ্রম ও মেধাকে সর্বোত্তম ও সুন্দরতম উপায়ে বিলিয়ে দেওয়া।

পূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহর বিধান ও সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা।

দুনিয়ার জীবনের বিনিময়ে আখিরাতকে ক্রয় করা।

এইরূপ আত্মত্যাগ ও উৎসর্গের ফলেই আল্লাহ প্রতিদানকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেন এবং "আজ্রুন কারীম" বা সম্মানিত পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। এটি প্রতিটি মুমিনের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত – আল্লাহর জন্য সবকিছু সর্বোৎকৃষ্টভাবে নিবেদন করা।

এই ব্যাখ্যা প্রচলিত ধারণার চেয়ে অনেক গভীর এবং মুমিনদেরকে আল্লাহর পথে নিজেদের সবকিছু বিলিয়ে দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত করে।

দুআ: 

"করদে হাসানা" এর যে গভীর ও আত্মিক তাৎপর্য (আল্লাহর জন্য সর্বোত্তমভাবে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া) তুলে ধরা হয়েছে, সেই অর্থে এই গুণ বা যোগ্যতা অর্জনের জন্য সরাসরি "আমাকে করদে হাসানার যোগ্যতা দাও" এমন নির্দিষ্ট শব্দে কোনো দু'আ আল-কুরআনে নেই।

তবে, আল-কুরআনে এমন অনেক দু'আ আছে যা এই ধরনের আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা, সর্বোত্তম আমল করার সামর্থ্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। এই দু'আগুলো নিয়মিত পাঠ ও এর মর্ম উপলব্ধি করার মাধ্যমে "করদে হাসানা"র পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য আল্লাহর সাহায্য কামনা করা যেতে পারে।

এখানে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক দু'আ দেওয়া হলো:

১. সর্বোত্তম আমল করার এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের দু'আ:

* رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ

* "রাব্বি আওঝি'নী আন আশকুরা নি'মাতাকাল্লাতী আন'আমতা 'আলাইয়্যা ওয়া 'আলা ওয়া-লিদাইয়্যা ওয়া আন আ'মালা স-লিহান তারদাহু ওয়া আদখিলনী বিরাহমাতিকা ফী 'ইবাদিকাস স-লিহীন।"

অর্থ: "হে আমার রব! আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন যাতে আমি আপনার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছেন এবং যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন। আর আপনার অনুগ্রহে আমাকে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন" (সূরা আন-নামল, ২৭:১৯)

* প্রাসঙ্গিকতা: এই দু'আয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ভালো কাজ (যা করদে হাসানার অন্তর্ভুক্ত) করার তৌফিক চাওয়া হয়েছে।

২. আল্লাহর পথে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার পর কবুলিয়াতের দু'আ (সালামুন আলা ইবরাহীম ও সালামুন আলা ইসমাঈল -এর দু'আ):

  رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ۖ إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ

* "রাব্বানা তাকাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস সামী'উল 'আলীম।"

অর্থ: "হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।" (সূরা আল-বাকারাহ, ২:১২৭)

* প্রাসঙ্গিকতা: যেকোনো ত্যাগ বা উৎসর্গ (যা করদে হাসানার মূল চেতনা) যেন আল্লাহ কবুল করেন, সেই প্রার্থনা এখানে রয়েছে।

৩. হিদায়াত ও আল্লাহর রহমতের জন্য দু'আ:

*  رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ

* "রাব্বানা লা তুযিগ্ কুলূবানা বা'দা ইয হাদাইতানা ওয়া হাবলানা মিল্লাদুনকা রাহমাহ, ইন্নাকা আনতাল ওয়াহ্হাব।"

অর্থ: "হে আমাদের রব! সরল পথ দেখানোর পর আপনি আমাদের অন্তরকে বক্র করে দেবেন না এবং আপনার নিকট থেকে আমাদেরকে রহমত দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা" (সূরা আলে ইমরান, ৩:৮)

* প্রাসঙ্গিকতা: আল্লাহর পথে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য সঠিক পথে অবিচল থাকা এবং আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রয়োজন।

৪. জান্নাত লাভের ও আল্লাহর নৈকট্যের জন্য দু'আ:

*  رَبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلْإِيمَانِ أَنْ آمِنُوا بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا ۚ رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الْأَبْرَارِ ‎﴿١٩٣﴾‏ رَبَّنَا وَآتِنَا مَا وَعَدتَّنَا عَلَىٰ رُسُلِكَ وَلَا تُخْزِنَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ۗ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادَ

* "রাব্বানা ইন্নানা সামি'না মুনাদিআই ইউনাদী লিল-ঈমানি আন আমিনূ বিরাব্বিকুম ফাআমান্না। রাব্বানা ফাগফিরলানা যুনূবানা ওয়া কাফফির 'আন্না সাইয়্যিআতিনা ওয়া তাওয়াফফানা মা'আল আবরার। রাব্বানা ওয়া আতিনা মা ওয়া'আদতানা 'আলা রুসুলিকা ওয়ালা তুখযিনা ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ। ইন্নাকা লা তুখলিফুল মী'আদ।"

অর্থ: "হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা একজন আহ্বানকারীকে ঈমানের দিকে আহ্বান করতে শুনেছি যে, ‘তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনো’। আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদের পাপ ক্ষমা করুন, আমাদের মন্দ কাজগুলো মোচন করুন এবং নেককারদের সাথে আমাদের মৃত্যু দিন। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে যা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা আমাদেরকে দান করুন এবং কিয়ামতের দিন আমাদেরকে অপমানিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।" (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৯৩-১৯৪)

* প্রাসঙ্গিকতা: এই দু'আয় ক্ষমা, সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুত পুরস্কার (যা করদে হাসানার প্রতিদান) লাভের আকুতি রয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

"করদে হাসানা" এর গভীর তাৎপর্য হলো আল্লাহর জন্য ইখলাস বা একনিষ্ঠতার সাথে নিজের প্রিয় বস্তু, সময়, শ্রম ও জীবনকে উৎসর্গ করা। উপরে উল্লেখিত দু'আগুলো এই ধরনের মানসিকতা তৈরি ও তা বজায় রাখার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার উত্তম মাধ্যম। এই দু'আগুলোর পাশাপাশি কুরআনের অর্থ বুঝে পড়া, এর নির্দেশাবলী মেনে চলার চেষ্টা করা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়াই "করদে হাসানা"র যোগ্যতা অর্জনের মূল উপায়।


Youtube: https://www.youtube.com/live/sdDFpO4Z-bc?si=xRIzdjQgGSI1eJkx

Powered by Blogger.