দুআ: রব্বানা-রব্বি বনাম আল্লাহুম্মা! 🤲
🔗রব্বানা-রব্বি বনাম আল্লাহুম্মা: ঐশী বিধানের বিরুদ্ধে মানব-রচিত বিকৃতি ও চ্যালেঞ্জ
ভূমিকা
দু'আ বা প্রার্থনা হলো স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সংযোগের সর্বোচ্চ মাধ্যম। আল্লাহর নাযিলকৃত একমাত্র, সংরক্ষিত ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান আল-কুরআন যখন তার অনুসারীদের প্রার্থনা করতে শেখায়, তখন তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য এক গভীর ও অপরিবর্তনীয় ঐশী তাৎপর্য বহন করে। একজন অনুসন্ধানী পাঠক হিসেবে কুরআনের দু'আগুলো অনুধাবন করলে একটি বিস্ময়কর কিন্তু সুস্পষ্ট প্যাটার্ন চোখে পড়ে: প্রায় সকল প্রার্থনাই শুরু হয়েছে ‘রব্বি’ (হে আমার রব! বা প্রতিপালক) অথবা ‘রব্বানা’ (হে আমাদের রব! বা প্রতিপালক) দিয়ে।
বিপরীতে, সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.আ.)-এর ওফাতের বহু শতাব্দী পর তাঁর নামে সংকলিত ও প্রচারিত মানব-রচিত গ্রন্থাবলিতে (যা হাদিস নামে পরিচিত) প্রার্থনার এক ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সেখানে ‘আল্লাহুম্মা’ (হে আল্লাহ) শব্দের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, যা কুরআনের মূল শিক্ষার সাথে এক সুস্পষ্ট ও সরাসরি সংঘাত তৈরি করে। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো, একমাত্র ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআনের অকাট্য দলিল দিয়ে বিশ্লেষণ করা যে, এই শব্দগত পার্থক্য কেবল ভাষাগত নয়, বরং এটি ঐশী নির্দেশনা এবং মানব-আবিষ্কৃত বিকল্প রীতির মধ্যে এক মৌলিক ঈমানগত পার্থক্যকে তুলে ধরে—যা আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে এক নীরব চ্যালেঞ্জ।
কুরআনিক দুআ (ভিডিও) নিচের দিকে দ্র:
১. আদি চুক্তি (The Primordial Covenant): প্রার্থনার একমাত্র ঐশী ভিত্তি:
কুরআন আমাদের শেখায় যে, মানুষ ও তার স্রষ্টার মধ্যকার সম্পর্কটি সৃষ্টির শুরুতেই ‘রব’ বা প্রতিপালক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে। সূরা আল-আ'রাফে আল্লাহ সেই আদি চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেন:
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ ... أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ۖ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا
"আর স্মরণ করুন! যখন আপনার রব আদম সন্তানদের... স্বীকারোক্তি নিলেন (এবং জিজ্ঞেস করলেন): 'আমি কি তোমাদের রব নই?' তারা বলল, 'অবশ্যই, আমরা সাক্ষী থাকলাম"-সূরা আল-আ'রাফ, ৭:১৭২
এই আয়াতটি প্রার্থনার ভাষার মূল ভিত্তি। আল্লাহ নিজেকে ‘রব’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তাই বান্দা যখন ‘রব্বি’ বা ‘রব্বানা’ বলে ডাকে, তখন সে মূলত সেই আদিম প্রতিজ্ঞাকেই স্মরণ ও স্বীকার করে নেয়। এটিই স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যকার সবচেয়ে মৌলিক, প্রাকৃতিক এবং আল্লাহ-প্রদত্ত সম্বোধন।
২. রাসূলের একমাত্র অনুসরণীয় (কুরআনিক দুআ সমেত) কেবলই অহী মানে আল-কুরআন:
রাসূলের (সা.আ.) অলঙ্ঘনীয় দায়িত্ব: কেবল অহীর অনুসরণ-
সেই আদি চুক্তিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং তাঁদের সর্বশেষ হলেন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.আ.)। তাঁর জীবনের একমাত্র মিশন ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অহী বা আল-কুরআনের অনুসরণ করা এবং তা মানুষের কাছে হুবাহু তা পৌঁছে দেওয়া।
- অহীর ঘোষণা: তিনি আল্লাহর আদেশে ঘোষণা দিয়েছেন: "...এই কুরআন আমার কাছে অহী করা হয়েছে, যেন এর দ্বারা আমি তোমাদেরকে এবং যাদের কাছে তা পৌঁছাবে, তাদের সবাইকে সতর্ক করি..." (সূরা আল-আন'আম, ৬:১৯)।
- একমাত্র অনুসরণ: তিনি তাঁর নিজের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন: "বলুন! ...আমি তো শুধু আমার প্রতি যা অহী করা হয়, তারই অনুসরণ করি" (সূরা আল-আহকাফ, ৪৬:৯)।
- কঠোর নিষেধাজ্ঞা: আল্লাহ তাঁকে অহীর বাইরে একটি শব্দও নিজের পক্ষ থেকে বলার অনুমতি দেননি। আল্লাহ কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন: "আর সে (রাসূল) যদি আমার নামে কোনো কথা বানিয়ে বলত, তবে আমি অবশ্যই তাকে ডান হাতে পাকড়াও করতাম। অতঃপর তার জীবন-ধমনী কেটে দিতাম।" (সূরা আল-হাক্কাহ, ৬৯:৪৪-৪৬)।
এই আয়াতগুলো অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, খাতামুন নাবিয়্যিন হিসেবে রাসূল (সা.আ.) নিজে কোনো দু'আ বানিয়ে বলেননি। তিনি কেবল তাই বলেছেন, ব্যবহার করেছেন এবং শিখিয়েছেন, যা তাঁকে অহীর মাধ্যমে অর্থাৎ আল-কুরআনে শেখানো হয়েছে। সুতরাং, তাঁর ব্যবহৃত দু'আগুলো ছিল কুরআনেরই ‘রব্বি’ ও ‘রব্বানা’ সম্বলিত দু'আ।
কুরআনের ঐশী দু'আ: 'রব্বি' ও 'রব্বানা' কেন্দ্রিক বিনয়:
"রব" (رَبّ) শব্দটি শুধু 'প্রভু' নয়; এর অর্থ প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা এবং ক্রমোন্নতি দানকারী। যখন কোনো বান্দা ‘রব্বি’ বা ‘রব্বানা’ বলে ডাক দেয়, তখন সে আল্লাহর প্রতিপালক গুণের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করে। এই সম্বোধনটি বান্দার অসহায়ত্ব, নির্ভরশীলতা এবং আল্লাহর করুণার প্রতি চূড়ান্ত মুখাপেক্ষিতাকে প্রকাশ করে। এটিই হলো কুরআনের শেখানো প্রার্থনার মূল ভিত্তি। কুরআন জুড়ে এই বিনয় ও আত্মসমর্পণের নজির বিদ্যমান:
৩.
কুরআনের দু'আ: রাসূল ও মু'মিনদের অভিন্ন পথ (কুরআনের পাতায় পাতায় সেই চুক্তির প্রতিফলন:)
যেহেতু
রাসূল (সা.আ.) কেবল কুরআনেরই
অনুসরণ করতেন, তাই কুরআনে বর্ণিত
দু'আগুলোই তাঁর ও সকল
মু'মিনের জন্য একমাত্র অনুসরণীয়
পথ (দ্র: ২:২৮৫)। এই ঐশী ভিত্তির
উপরেই কুরআনের সকল প্রার্থনা নির্মিত
হয়েছে।
- মানবজাতির প্রথম প্রার্থনা: আদম (সা.আ.) ও তার স্ত্রী তাদের ভুলের পর আল্লাহর শেখানো ভাষায় বললেন: "রব্বানা জালামনা আনফুসানা..." (সূরা আল-আ'রাফ, ৭:২৩)।
- সার্বজনীন ক্ষমা ও করুণার প্রার্থনা: আল্লাহ সরাসরি আদেশ করছেন: "আর বলুন, ‘হে আমার রব! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন এবং আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’" (সূরা আল-মুমিনুন, ২৩:১১৮)।
- নবী ইবরাহীমের প্রার্থনা: "হে আমার রব! আমাকে সালাত প্রতিষ্ঠাকারী করুন... হে আমাদের রব! আর আমার দু'আ কবুল করুন" (সূরা ইবরাহীম, ১৪:৪০)।
- শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা: "হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন..." (সূরা আল-বাকারাহ, ২:২০১)।
এই প্রতিটি দু'আ ‘রব’ সম্বোধনের মাধ্যমে সেই আদি চুক্তি (৭:১৭২) এবং রাসূলের কঠোর অনুসরণের (৪৬:৯) সাক্ষ্য বহন করে।
৪.
কুরআনে 'আল্লাহুম্মা'-এর ব্যবহার: ব্যতিক্রম যা মূল নিয়মকেই প্রমাণ করে:
‘আল্লাহুম্মা’
শব্দটি কুরআনে আছে, কিন্তু এর
সীমিত ব্যবহার এবং বিশেষ প্রেক্ষাপট
কুরআনের মূল শিক্ষাকেই আরও
শক্তিশালী করে।
- ক্ষমতার ঘোষণা (৩:২৬) ও জান্নাতবাসীদের প্রশংসা (১০:১০): এগুলো আবেদনমূলক দু'আ নয়।
- 'রব্বানা'র সাথে সংযুক্ত (৫:১১৪): এখানে ‘আল্লাহুম্মা’ বলার সাথে সাথেই কুরআনি রীতি ‘রব্বানা’ যুক্ত করে মূল ভিত্তিকেই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
- কাফিরদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জ (৮:৩২): এটি সবচেয়ে ভয়াবহ উদাহরণ। সত্য অস্বীকারকারীরা চরম ঔদ্ধত্যবশত আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিল, "হে আল্লাহ যদি এটাই সত্য হয়, তবে আমাদের উপর পাথর বর্ষণ করুন...।" কুরআন অনুযায়ী, এটিই একমাত্র স্থান যেখানে কোনো গোষ্ঠী স্বতন্ত্রভাবে ‘আল্লাহুম্মা’ বলে আবেদন করছে, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য বিনয় নয়—বরং বিদ্রোহ।
৫.
মানব-রচিত বিকল্প: ঔদ্ধত্যের প্রতিধ্বনি ও এক পরিকল্পিত বিচ্যুতি
কুরআনের এই সুস্পষ্ট ও বিনয়কেন্দ্রিক রীতির বিপরীতে, রাসূল -এর নামে প্রচলিত মানব-সৃষ্ট গ্রন্থগুলোতে (হাদিসে) ‘আল্লাহুম্মা’ দিয়ে শুরু হওয়া প্রার্থনার এক নতুন ধারা প্রবর্তন করা হয়েছে। এটি কুরআনের ‘রব্বানা’ কেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে একটি সুস্পষ্ট ও পরিকল্পিত বিচ্যুতি।
এর উৎস অনুসন্ধান করলে সূরা আনফালের ৩২ নম্বর আয়াতের কাফিরদের ঔদ্ধত্যের সাথেই এর এক গভীর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পথভ্রষ্ট কাফিররা আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করে এসব হাদিস আবিষ্কার করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর শেখানো বিনয়ের পথ থেকে মানুষকে সরিয়ে এক নতুন রীতির প্রচলন করা, যা বাহ্যিকভাবে আকর্ষণীয় হলেও আত্মিকভাবে অহংকার ও বিদ্রোহের প্রতীক। ফলে সাধারণ মানুষ আল্লাহর দেওয়া আদি প্রতিশ্রুতি (৭:১৭২) ভুলে গিয়ে ওসব মানব-রচিত বিকল্পের অনুসরণ করছে এবং অজান্তেই সেই ঔদ্ধত্যের ভাষার অনুকরণ করছে, যা আল্লাহ কাফিরদের মুখ থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
৫. শব্দের বিকৃতি ও বিকল্প আবিষ্কার: একটি ঐতিহাসিক অপরাধ:
আল্লাহর বিধানের শব্দ পরিবর্তন বা বিকৃত করা একটি গুরুতর অপরাধ, যা নতুন নয়। বনী ইসরাঈলকে যখন একটি জনপদে প্রবেশ করে "হিত্তাতুন" (حِطَّةٌ - ক্ষমা চাই) বলতে বলা হয়েছিল, তখন তারা তা বিকৃত করেছিল।
"...কিন্তু যালিমরা তাদের যা বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করল। সুতরাং আমি যালিমদের উপর তাদের অবাধ্যতার কারণে আকাশ থেকে শাস্তি প্রেরণ করলাম"-২:৫৯
একইভাবে সূরা আল-আ'রাফের ১৬২ নম্বর আয়াতেও এই ঘটনা পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। একটি মাত্র শব্দ বিকৃত করার পরিণতি ছিল ভয়াবহ ঐশী শাস্তি।
আল্লাহর রসূলের নামে হাদিস আবিস্কার: আজকের স্বঘোষিত মুসলিম নামধারীরাও কি এই বিকৃতি ও বিকল্প আবিষ্কারে পিছিয়ে আছে? কুরআন অনুযায়ী, তারা পূর্ববর্তীদের থেকেও কম নয়। আল্লাহ বলেন:
"সুতরাং দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং সামান্য মূল্য লাভের জন্য বলে, 'এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে'। তাদের হাত যা রচনা করেছে, তার জন্য তাদের ধ্বংস এবং যা তারা উপার্জন করে, তার জন্যও তাদের ধ্বংস"-২:৭৯
এই আয়াতটি সরাসরি হাদিস ও অন্যান্য মানব-রচিত গ্রন্থ রচনার দিকে ইঙ্গিত করে, যেগুলোকে আল্লাহর রাসূলের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘রব্বানা’র পরিবর্তে ‘আল্লাহুম্মা’র ব্যাপক প্রচলন এই বিকৃতিরই একটি আধুনিক রূপ। এটি ‘হিত্তাতুন’কে পরিবর্তন করার মতোই একটি অপরাধ—আল্লাহর শেখানো বিনয়ের ভাষাকে একটি মানব-রচিত ঔদ্ধত্যের ভাষায় রূপান্তরিত করা।
আল্লাহ আরও প্রশ্ন করেন:
"নাকি তাদের এমন কোনো শরীক (অংশীদার) আছে, যারা তাদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান দিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ দেননি?" (সূরা আশ-শূরা, ৪২:২১)
হাদিসের নামে প্রচলিত এই ‘আল্লাহুম্মা’ সম্বলিত দু'আগুলো ঠিক তাই—আল্লাহর অনুমতি ছাড়াই দ্বীনের মধ্যে নতুন বিধান সংযোজন।
১. আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ মানেই কুরআনের অনুসরণ
আল্লাহর রাসূল নিজের ইচ্ছামত কোনো ইবাদত বা দু'আ চালু করেননি। তাঁর একমাত্র দায়িত্ব ছিল অহী বা আল-কুরআনের অনুসরণ করা।
রাসূলের নিজের স্বীকারোক্তি:
"বলুন! আমি কোনো নতুন রাসূল নই... আমি তো শুধু আমার প্রতি যা অহী করা হয়, তারই অনুসরণ করি।" (সূরা আল-আহকাফ, ৪৬:৯)
কুরআন পরিবর্তনের এখতিয়ারহীনতা:
"আর যখন তাদের কাছে আমার সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয়, তখন যারা আমার সাক্ষাতের আশা রাখে না, তারা বলে, ‘এ ছাড়া অন্য একটি কুরআন নিয়ে আসুন অথবা এটি পরিবর্তন করুন।’ বলুন! ‘আমার নিজের পক্ষ থেকে এটি পরিবর্তন করার কোনো এখতিয়ার নেই। আমি কেবল আমার প্রতি যা অহী করা হয়, তারই অনুসরণ করি"-১০:১৫)
এই আয়াতটি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করে যে, আল্লাহর রাসূল কুরআনের একটি শব্দও পরিবর্তন করতে পারতেন না। সুতরাং, তিনি যে দু'আ, তাসবীহ বা যিকির করেছেন, তা অবশ্যই কুরআনেরই অংশ ছিল।
২. মু'মিনদের প্রতি সরাসরি নির্দেশ: নাযিলকৃত বিধানের হুবহু অনুসরণ:
আল্লাহর রাসূল যেমন অহীর অনুসরণ করেছেন, তেমনি আল্লাহ মু'মিনদেরকেও সরাসরি সেই অহী বা কুরআনকেই অনুসরণ করতে আদেশ করেছেন, অন্য কিছু নয়।
সরাসরি আদেশ:
"তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে, তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কোনো অলি-আউলিয়া (অভিভাবক) অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করো" (সূরা আল-আ'রাফ, ৭:৩)
এখানে "যা নাযিল করা হয়েছে" (مَا أُنزِلَ) বলতে সুনির্দিষ্টভাবে আল-কুরআনকে বোঝানো হয়েছে।
সর্বোত্তম বিধানের অনুসরণ:
"আর তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তার সর্বোত্তমটুকু অনুসরণ কর, তোমাদের উপর অতর্কিতে আযাব আসার পূর্বে, যখন তোমরা উপলব্ধিও করতে পারবে না।" (সূরা আয-যুমার, ৩৯:৫৫)
আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানই "সর্বোত্তম" (أَحْسَن)। এর বাইরে মানুষের তৈরি কোনো কিছু উত্তম হতে পারে না।
৩. কুরআন নিজেই সর্বোত্তম যিকির এবং তার শব্দাবলীই সর্বোত্তম তাসবীহ
কুরআন শুধু একটি বিধান গ্রন্থ নয়, এটি নিজেই আল্লাহর সর্বোত্তম যিকির (স্মরণ) এবং এর আয়াতগুলোই সর্বোত্তম তাসবীহ (মহিমা ঘোষণা)।
কুরআনের নাম 'আয-যিকির':
"নিশ্চয় আমিই এই ‘যিকির’ (কুরআন) নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।" (সূরা আল-হিজর, ১৫:৯)
যেহেতু কুরআন নিজেই "যিকির", তাই কুরআনের আয়াত পাঠ করাই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির। আলাদা করে মানব-রচিত কোনো যিকিরের প্রয়োজন নেই।
আল্লাহর শেখানো তাসবীহ:
কুরআনে আল্লাহ নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে তাঁর তাসবীহ করতে হবে। যেমন:
"অতএব, তারা যা বলে তাতে ধৈর্য ধারণ করুন এবং আপনার রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করুন সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে" (সূরা ক্বাফ, ৫০:৩৯)
এই তাসবীহ কী হবে? তা-ও কুরআনেই আছে। যেমন: "সুবহানাল্লাহি আম্মা ইয়াসিফুন" (তারা যা আরোপ করে তা থেকে আল্লাহ পবিত্র) (৩৭:১৫৯) অথবা "সুবহানাকা" (আপনি মহাপবিত্র) বলে শুরু হওয়া আয়াতগুলো। এর বাইরে কিছু বানিয়ে বলা আল্লাহর শেখানো রীতির লঙ্ঘন।
৪. শব্দ পরিবর্তনের পরিণতি: একটি কঠোর সতর্কবার্তা
আল্লাহর দেওয়া শব্দাবলীকে সামান্য পরিবর্তন করা বা তার পরিবর্তে অন্য কিছু ব্যবহার করা একটি মারাত্মক অপরাধ। বনী ইসরাঈলের ঘটনা আমাদের জন্য একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন।
‘হিত্তাতুন’-এর ঘটনা:
"...কিন্তু যালিমরা তাদের যা বলা হয়েছিল, তার পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করল। সুতরাং আমি যালিমদের উপর তাদের অবাধ্যতার কারণে আকাশ থেকে শাস্তি প্রেরণ করলাম" (সূরা আল-বাকারাহ, ২:৫৯)
বনী ইসরাঈলকে একটি নির্দিষ্ট শব্দ ("হিত্তাতুন") বলতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তারা তা বিকৃত করেছিল। একইভাবে, আল্লাহ যখন আমাদের প্রার্থনার জন্য ‘রব্বানা’ ও ‘রব্বি’ শব্দগুলো শিখিয়ে দিয়েছেন, তখন এর পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দ (যেমন: ‘আল্লাহুম্মা’) দিয়ে প্রার্থনা শুরু করা সেই একই ধরনের বিকৃতির শামিল।
উপসংহার
যারা
একমাত্র রবের নাযিলকৃত, সংরক্ষিত
ও পূর্ণাঙ্গ বিধান আল-কুরআনকে জীবন
পরিচালনার ভিত্তি হিসেবে বিশ্বাস করে, তাদের জন্য
প্রার্থনার পদ্ধতি দ্ব্যর্থহীনভাবে পরিষ্কার।
১. আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতেই (৭:১৭২) নিজেকে
আমাদের ‘রব’ হিসেবে পরিচয়
দিয়েছেন এবং আমরা তা
স্বীকার করে নিয়েছি।
২. আল্লাহর রাসূল কঠোরভাবে কেবল
অহী বা কুরআনের অনুসরণ
করতে আদিষ্ট ছিলেন (৬৯:৪৪-৪৬,
৪৬:৯)।
৩. আমাদেরকেও আল্লাহ কেবল তাঁর নাযিলকৃত
বিধানের অনুসরণ করতে আদেশ করেছেন
(৭:৩)।
অতএব,
কুরআনের ‘রব্বানা’ ও ‘রব্বি’ সম্বলিত
দু'আগুলোই হলো একমাত্র খাঁটি,
ঐশী, আল্লাহর রাসূল কর্তৃক ব্যবহৃত
এবং আমাদের জন্য অনুসরণীয় পথ।
প্রার্থনার ক্ষেত্রে মানব-রচিত গ্রন্থাবলিতে
‘আল্লাহুম্মা’-এর ব্যাপক প্রচলন
আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান থেকে একটি মারাত্মক
বিচ্যুতি এবং একটি মানব-আবিষ্কৃত বিকল্প, যা কুরআনের শিক্ষার
সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। একজন প্রকৃত বিশ্বাসীর
জন্য আল্লাহর শেখানো ‘রব্বানা’ এবং ‘রব্বি’-এর
পথই হলো একমাত্র নিরাপদ,
বিনয়পূর্ণ এবং বিশুদ্ধ পথ—যা যেকোনো মানব-আবিষ্কৃত বিকল্প রীতির বহু ঊর্ধ্বে।
কুরআনিক দুআ (ভিডিও)-1
কুরআনিক দুআ (ভিডিও)-2
Leave a Comment