আগে দুআ-প্রার্থনা-আবেদন তারপর পরিকল্পনা। পরিকল্পনা করার পর সেই পরিকল্পনাকে সফল করতে প্রার্থনা নয় -Pray first and then make Plans. Don't Plan and then Pray for your Plan to work

না, আগে নিজের মতো করে সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে, তারপর সেই পরিকল্পনাকে সফল করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা একজন মুমিনের জন্য সর্বোত্তম বা সবচেয়ে শোভনীয় পন্থা নয়  —এই উক্তিটি শুধু একটি অনুপ্রেরণামূলক বাক্য নয়, বরং এটি কোরআনিক প্রজ্ঞা ও জীবনদৃষ্টির এক চমৎকার সারসংক্ষেপ। একজন মুমিনের জীবন দর্শনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করে এই দর্শন- আল-কোরআন অনুধাবনের আলোকে):

দুআ: ভিডিও (শেষের দিকে দ্র:)


প্রথমে প্রার্থনা, তারপর পরিকল্পনা: কোরআনিক জীবনদৃষ্টি

আধুনিক স্ব-উন্নয়ন (self-help) জগতে প্রায়শই আমাদের শেখানো হয়: "একটি নিখুঁত পরিকল্পনা তৈরি করো, লক্ষ্য স্থির করো এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করো।" এই দর্শনে স্রষ্টার ভূমিকা প্রায়শই গৌণ। বড়জোর, নিজের তৈরি করা নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য  সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়। এই পদ্ধতিটি হলো: "পরিকল্পনা, তারপর প্রার্থনা।"

কিন্তু আল-কোরআন আমাদের এক ভিন্ন, গভীরতর এবং অধিক প্রশান্তিময় পথের দিশা দেয়। কোরআনিক জীবনদৃষ্টি এর ঠিক বিপরীত: "প্রথমে প্রার্থনা, তারপর পরিকল্পনা।" এর অর্থ হলো, নিজের সীমিত জ্ঞান ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে পথচলা শুরু না করে, সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে পথনির্দেশ, জ্ঞান ও সাহায্য চেয়ে তারপর তাঁর দেখানো আলোয় নিজের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা সাজানো।

আল্লাহ বলেন:

وَيَمْكُرُونَ وَيَمْكُرُ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ

অর্থ: "তারাও পরিকল্পনা করে, আর আল্লাহও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী" (সূরা আল-আনফাল, ৮:৩০)

সুতরাং, নিজের পরিকল্পনাকে আল্লাহর পরিকল্পনার উপরে স্থান দেওয়া শোভনীয় নয়।

কেন এটি শোভনীয় নয়?

১. ভূমিকার পরিবর্তন: নিজেকে চালক ও আল্লাহকে চালকের সহকারী মনে করা

যখন একজন ব্যক্তি প্রথমে নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা তৈরি করে এবং তারপর আল্লাহর কাছে বলে, "হে আল্লাহ! আমার এই পরিকল্পনাটি সফল করে দাও," তখন সে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আল্লাহ ও নিজের ভূমিকাকে ওলটপালট করে ফেলে।

আসুন, কোরআনের আয়নার মাধ্যমে এই দুটি দর্শনের পার্থক্য দেখি।

২. দু'আর প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যকে খাটো করা:

দু'আ শুধু নিজের ইচ্ছা পূরণের একটি মাধ্যম নয়। দু'আ হলো আল্লাহর প্রতি নিজের অসহায়ত্ব, সীমাবদ্ধতা ও নির্ভরশীলতা প্রকাশ করার সর্বোচ্চ মাধ্যম।

অশোভন পন্থা: যখন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দু'আ করা হয়, তখন দু'আটি একটি চাহিদা বা আবদারে পরিণত হয়। এর ভাবার্থ দাঁড়ায়: "আমি যা ভালো মনে করেছি, তুমি এখন সেটাকে কবুল করো।"


শোভনীয় পন্থা: কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আল্লাহর কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করা। যখন পরিকল্পনার আগে দু'আ করা হয়, তখন দু'আটি হয় পথনির্দেশ ও কল্যাণের জন্য আকুতি। এর ভাবার্থ দাঁড়ায়: "রব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আ-খিরাতি হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র  অর্থ: হে আমাদের রব, আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে আগুনের আযাব থেকে রক্ষা করুন-আয়াত 2:২০১।"


তার মানে দাঁড়ায়, হে আমার রব, যদি এই কাজটি আমার জন্য কল্যাণকর হয়, তবে তা আমার জন্য সহজ করে দিন। আর যদি অকল্যাণকর হয়, তবে আমাকে তা থেকে ফিরিয়ে রাখুন। এবং যেখানে কল্যাণ আছে, সেখানেই আমাকে সন্তুষ্ট রাখুন।"

এই দু'আ আমাদের শেখায় যে, আমাদের পরিকল্পনা নয়, বরং আল্লাহর নির্বাচিত কল্যাণই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।

৩. তাওয়াক্কুল (ভরসা) এর সঠিক অনুশীলনের অভাব

"আগে পরিকল্পনা, পরে প্রার্থনা" মডেলে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা থাকে গৌণ। এখানে ভরসার মূল কেন্দ্রবিন্দু থাকে নিজের পরিকল্পনার উপর।

حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

হাসবুনাল্লা-হু ওয়া নিমাল ওয়াকীল 

আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম! 

কঠিন পরিস্থিতিতে ঈমানদারদের এই উক্তি আল্লাহ উল্লেখ করেছেন-সূরা আলে ইমরান 3:১৭৩।

حَسْبِيَ اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۖ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ ۖ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ

হাসবিয়াল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়া, আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া হুয়া রব্বুল আরশিল আযীম। 

আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। আমি তাঁরই উপর তাওয়াক্কুল করেছি এবং তিনি মহা আরশের রব"-সূরা আত-তাওবাহ, 9:১২৯ 

অশোভন পন্থা: পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে এবং ভাবতে পারে, "আমার এত নিখুঁত পরিকল্পনা কেন কাজ করল না?" এতে আল্লাহর প্রজ্ঞার উপর প্রশ্ন তোলার মতো ধৃষ্টতা চলে আসতে পারে।

শোভনীয় পন্থা: "আগে প্রার্থনা, পরে পরিকল্পনা" মডেলে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল থাকে মুখ্য। পরিকল্পনা সফল হলে মুমিন শুকরিয়া আদায় করে, কারণ সে জানে এটা আল্লাহরই দান। আর ব্যর্থ হলে সে ধৈর্যধারণ করে এবং বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তাকে হয়তো আরও বড় কোনো অকল্যাণ থেকে রক্ষা করেছেন অথবা এর চেয়ে উত্তম কিছু তার জন্য রেখেছেন।

১. পরিকল্পনা, তারপর প্রার্থনা: মানুষের অহংকারের প্রতিফলন

যখন একজন মানুষ প্রথমে নিজের পরিকল্পনা তৈরি করে এবং তারপর আল্লাহর কাছে বলে, "হে আল্লাহ, আমার এই পরিকল্পনাটি সফল করে দাও," তখন সে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কয়েকটি ভুল করে:

  • নিজেকে পরিকল্পনাকারী ও আল্লাহকে বাস্তবায়নকারী মনে করা: এই মডেলে মানুষ নিজেকে চালকের আসনে বসায় এবং আল্লাহকে তার সহকারী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। সে নিজের জ্ঞানকে চূড়ান্ত মনে করে এবং আল্লাহর কাছে শুধু তার বাস্তবায়নের শক্তিটুকু চায়।

  • আল্লাহর ইচ্ছাকে শর্তযুক্ত করা: এই প্রার্থনার মধ্যে এক ধরনের সূক্ষ্ম ঔদ্ধত্য লুকিয়ে থাকে। এর ভাবার্থ দাঁড়ায়: "আমার পরিকল্পনাটিই সেরা, এখন তোমার কাজ হলো এটিকে সফল করা।" এটি আল্লাহর অসীম প্রজ্ঞার উপর নিজের সীমিত প্রজ্ঞাকে স্থান দেওয়ার শামিল।

  • ব্যর্থতায় হতাশা: যেহেতু পরিকল্পনাটি নিজের তৈরি, তাই তা ব্যর্থ হলে মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে। সে ভাবতে শুরু করে, "আমার এত সুন্দর পরিকল্পনা কেন ব্যর্থ হলো?" অথবা আল্লাহর উপর অভিমান করে বসে।

এই পদ্ধতিটি মানুষের "নফস" বা অহংবোধকে তৃপ্ত করে, কিন্তু এতে আত্মসমর্পণ বা তাওয়াক্কুলের গভীরতা থাকে না।

২. প্রথমে প্রার্থনা, তারপর পরিকল্পনা: আত্মসমর্পণের সৌন্দর্য

কোরআনিক পদ্ধতি আমাদের শেখায়, যেকোনো কাজের শুরুতে নিজের জ্ঞান ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে নেওয়া এবং সকল জ্ঞানের উৎস আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া।

ক. হেদায়েতের জন্য প্রার্থনা: সঠিক পথের দিশা চাওয়া
একজন মুসলিমের জীবনের সবচেয়ে বড় "প্রথমে প্রার্থনা" হলো সূরা আল-ফাতিহা। আমরা প্রতিদিন অন্তত সতেরোবার বলি:

اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ
অর্থ: "আমাদেরকে সরল-সঠিক পথে পরিচালিত করুন" (সূরা আল-ফাতিহা, ১:৬)

এখানে আমরা আল্লাহর কাছে আমাদের তৈরি করা কোনো নির্দিষ্ট পথকে "সঠিক" বানিয়ে দিতে বলি না। বরং আমরা শুরুতেই তাঁর কাছে সেই পথটিই চাই, যা তাঁর দৃষ্টিতে সঠিক। এটাই হলো সকল পরিকল্পনার মূল ভিত্তি।

খ. জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কাজের সহজতার জন্য প্রার্থনা
কোরআনের নবী-রাসূলগণের জীবন এই নীতির সর্বোত্তম উদাহরণ।  সালামুন আলা মুসা -কে যখন ফিরাউনের কাছে যাওয়ার মতো কঠিন দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি নিজের পরিকল্পনা নিয়ে হাজির হননি। বরং তিনি প্রথমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন:

رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي
অর্থ: "হে আমার রব! আমার বক্ষকে প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজকে আমার জন্য সহজ করে দিন" (সূরা ত্ব-হা, ২০:২৫-২৬)
 

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, মুসা (সা.আ.) নিজের পরিকল্পনা পেশ করে তা সফল করার জন্য দু'আ করেননি। বরং তিনি আল্লাহর কাছে মানসিক শক্তি (বক্ষ প্রশস্ত হওয়া) এবং কাজের অনুকূল পরিবেশ (কাজ সহজ হওয়া) প্রার্থনা করেছেন, যাতে তিনি আল্লাহর দেওয়া দায়িত্বটি সর্বোত্তমভাবে পালন করতে পারেন।


একইভাবে, আসহাবুল কাহফ বা গুহাবাসী যুবকেরা যখন ঈমান বাঁচাতে এক অনিশ্চিত যাত্রায় বেরিয়েছিলেন, তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। তাদের সম্বল ছিল কেবল আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং একটি আন্তরিক দু'আ:

رَبَّنَا آتِنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا
অর্থ: "হে আমাদের রব! আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে বিশেষ রহমত দান করুন এবং আমাদের এই কাজটির জন্য সঠিক পথনির্দেশ প্রস্তুত করে দিন" -১৮:১০
তারা আল্লাহর কাছে রাشادা বা "সঠিক পথনির্দেশ" চেয়েছেন, যাতে সেই অনুযায়ী তারা তাদের পদক্ষেপ নিতে পারে।

সালামুন আলা মুসা -এর দু'আ: আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত প্রকাশ:

সূরা আল-কাসাস, ২৮:২৪

...رَبِّ إِنِّي لِمَا أَنزَلْتَ إِلَيَّ مِنْ خَيْرٍ فَقِيرٌ

"রব্বি ইন্নী লিমা আনযালতা ইলাইয়্যা মিন খইরিন ফাক্বীর"

অর্থ: "হে আমার রব! আপনি আমার প্রতি যে কোনো কল্যাণ নাযিল করবেন, আমি তার (জন্য) একান্ত মুখাপেক্ষী/কাঙাল।"

প্রেক্ষাপট: এই দু'আটির শক্তি বোঝার জন্য এর প্রেক্ষাপট জানা অপরিহার্য।  মুসা (সা.আ.) তখন কী অবস্থায় ছিলেন?

পলাতক: তিনি একজন ব্যক্তিকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে মিশর থেকে নিজের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছেন। নিঃস্ব: রাজপ্রাসাদে বেড়ে ওঠা মুসা (সা.আ.) এখন একজন নিঃস্ব পথিক। তাঁর কাছে কোনো অর্থ, খাদ্য, বা আশ্রয় নেই।  একাকী: তিনি মাদইয়ান নামক এক অচেনা শহরে সম্পূর্ণ একা। তাঁর কোনো বন্ধু বা পরিচিত কেউ নেই।  অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ: তাঁর সামনে কী আছে, তিনি কিছুই জানেন না। তাঁর কোনো পরিকল্পনা নেই, কারণ পরিকল্পনা করার মতো কোনো অবস্থাই তাঁর ছিল না।

এই চরম অসহায় মুহূর্তেও তিনি দুটি মেয়েকে তাদের পশুপালকে পানি পান করাতে সাহায্য করলেন, কোনো প্রতিদানের আশা না করেই। এরপর একটি গাছের ছায়ায় বসে তিনি এই দু'আটি করেছিলেন।

এই দু'আ কীভাবে "প্রথমে প্রার্থনা, পরে পরিকল্পনা" নীতির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ?

১. কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই, আছে শুধু প্রয়োজন:

মুসা (সা.আ.) আল্লাহর কাছে বলেননি, "হে আল্লাহ, আমাকে একটি চাকরি দাও," "আমাকে একটি বাড়ি দাও," অথবা "আমাকে খাবার দাও।" তিনি তাঁর প্রয়োজনগুলোকে একটি তালিকা বানিয়ে আল্লাহর সামনে পেশ করেননি। তিনি জানতেন, তাঁর প্রয়োজন অনেক, কিন্তু কোনটি সবচেয়ে জরুরি, তা আল্লাহই ভালো জানেন।


২. ব্যাপক ও উন্মুক্ত প্রার্থনা:

তিনি বলেছেন: "মিন খইরিন" (مِنْ خَيْرٍ) অর্থাৎ "যে কোনো কল্যাণ"।  'খাইর' বা কল্যাণ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। এর মধ্যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, নিরাপত্তা, একজন ভালো সঙ্গী, মানসিক শান্তি, সঠিক পথনির্দেশ—সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত। তিনি নিজের জন্য পরিকল্পনা না করে, পরিকল্পনার ভার পুরোপুরি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, "আপনি যা-ই কল্যাণকর মনে করে পাঠাবেন, আমি সেটারই কাঙাল।"

৩. চরম অসহায়ত্বের স্বীকৃতি (ফাক্বীর):

এই দু'আর সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দ হলো "ফাক্বীর" (فَقِيرٌ)। এর অর্থ শুধু 'দরিদ্র' বা 'মুখাপেক্ষী' নয়, এর অর্থ হলো—"আমি একেবারে নিঃস্ব, কাঙাল, desperate।" এটি হলো অহংকারের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি। তিনি নিজের শক্তি, বুদ্ধি বা যোগ্যতার কোনো উল্লেখই করেননি। তিনি আল্লাহর সামনে নিজের চরম দুর্বলতা এবং তাঁর অসীম করুণার প্রতি নিজের চরম নির্ভরশীলতা প্রকাশ করেছেন।

একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে শোভনীয় আর কী হতে পারে? সে নিজের পরিকল্পনাকে আঁকড়ে ধরে থাকার বদলে, আল্লাহর সামনে একজন 'ফাকীর' বা কাঙাল হয়ে হাত পাতছে।

দু'আর ফলাফল: আল্লাহর নিখুঁত পরিকল্পনা

যখন মুসা (সা.আ.) নিজের পরিকল্পনা শূন্য করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন, তখন আল্লাহ তাঁর জন্য এমন এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলেন, যা তিনি নিজে কখনো কল্পনাও করতে পারতেন না।

অবিলম্বে সাড়া: দু'আ শেষ হতে না হতেই সেই মেয়েদের একজন লাজুক পায়ে তাঁর কাছে ফিরে আসে।

খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা: তাকে তাদের পিতার  কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি খাদ্য ও নিরাপত্তা লাভ করেন।

কর্মসংস্থান ও পারিবারিক জীবন: তাঁকে একটি সম্মানজনক কাজের (পশুপাল) প্রস্তাব দেওয়া হয় এবং সেই মেয়েদের একজনের সাথে তাঁর বিয়ে হয়।

মুসা (সা.আ.) শুধু "যেকোনো কল্যাণ" চেয়েছিলেন, আর আল্লাহ তাঁকে খাদ্য, আশ্রয়, নিরাপত্তা, চাকরি এবং পরিবার—সবই দান করলেন। তিনি নিজের জন্য পরিকল্পনা করেননি, তাই আল্লাহ তাঁর জন্য সর্বোত্তম পরিকল্পনাটিই করলেন।

শিক্ষা:  

এই দু'আটি আমাদের শেখায়—যখন আমরা নিজেদের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তখন আমরা আল্লাহর অসীম সম্ভাবনাকে সীমিত করে ফেলি। কিন্তু যখন আমরা নিজেদেরকে 'ফাকীর' মেনে নিয়ে তাঁর কাছে "যেকোনো কল্যাণ" প্রার্থনা করি, তখন আমরা আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও করুণার দরজা খুলে দিই।

সুতরাং, একজন মুমিনের জন্য এর চেয়ে শোভনীয় আর কিছু নেই যে, সে নিজের তৈরি করা পরিকল্পনা নিয়ে আল্লাহর কাছে যাওয়ার পরিবর্তে,  মুসা (আঃ)-এর মতো বলবে: "হে আমার রব, আমি জানি না আমার কী প্রয়োজন, কিন্তু আমি এটুকু জানি যে, আপনি আমার প্রতি যে কোনো কল্যাণই নাযিল করবেন, আমি তার জন্য আপনার দুয়ারে একজন কাঙাল মাত্র।"

আগে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ ও প্রার্থনা, তারপর পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা:

এটি শুধু একটি কর্মপন্থা নয়, বরং এটি 'তাওয়াক্কুল' (আল্লাহর উপর ভরসা) এর সঠিক রূপ। আপনার উল্লেখ করা নবীদের উদাহরণগুলো এই নীতিকেই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে।

১. দু'আ হলো ইবাদতের মূল:

নবী-রাসুলরা জানতেন যে, যেকোনো কাজের সফলতা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। তাই তারা নিজেদের প্রজ্ঞা বা শক্তির উপর ভরসা করার আগে, শক্তির মূল উৎস মহান আল্লাহর কাছে আবেদন করতেন। এটি ছিল তাদের বিনয়, দাসত্ব এবং আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসের প্রকাশ। দু'আ করার মাধ্যমে তারা স্বীকার করতেন যে, "হে আল্লাহ, আমি অক্ষম, তুমিই সর্বশক্তিমান। আমি তোমার সাহায্য ছাড়া এক কদমও এগোতে পারবো না।"

২. আল্লাহর নির্দেশনা ও সাহায্য প্রার্থনা:

পরিকল্পনা করার আগে দু'আ করার অর্থ হলো—আল্লাহর কাছে সঠিক পথের দিশা চাওয়া। মানুষ হিসেবে আমাদের জ্ঞান সীমিত। আমাদের পরিকল্পনা ভুল হতে পারে। কিন্তু যখন আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তখন আমরা বলি, "হে আল্লাহ, আমার জন্য যা কল্যাণকর, সেই পথ আমার জন্য সহজ করে দাও এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করার তৌফিক দাও।"

► নবী জাকারিয়া (আঃ): তিনি যখন সন্তানের জন্য দু'আ করেন, তখন তিনি নিজের বার্ধক্য এবং স্ত্রীর বন্ধ্যাত্বের মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি আল্লাহর সামনে তুলে ধরেছিলেন। তিনি কোনো পরিকল্পনা করেননি, বরং সরাসরি আল্লাহর অলৌকিক সাহায্যের জন্য আবেদন করেছিলেন (সূরা মারইয়াম: ৪-৬)।


নবী ইব্রাহীম (আঃ): তিনি মক্কা নগরী প্রতিষ্ঠা করার পর কোনো ব্যবসায়িক বা সামাজিক পরিকল্পনা করেননি। বরং তার প্রথম কাজ ছিল আল্লাহর কাছে দু'আ করা—"হে আমার রব, এই শহরকে নিরাপদ করুন এবং এর অধিবাসীদের ফলমূল দিয়ে জীবিকা দান করুন" (সূরা বাকারা: ১২৬)।

► নবী সোলায়মান (আঃ): তিনি এমন এক রাজত্ব চেয়েছিলেন যা তার পরে আর কেউ পাবে না। এটি কোনো জাগতিক পরিকল্পনা ছিল না, বরং ছিল সরাসরি আল্লাহর কাছে এক বিশেষ অনুগ্রহের আবেদন (সূরা সাদ: ৩৫)।

৩. পরিকল্পনা করে প্রার্থনা করা এবং প্রার্থনার পর পরিকল্পনা করার মধ্যে পার্থক্য:

পরিকল্পনা করে প্রার্থনা: এই পদ্ধতিতে মানুষ নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। এরপর সে আল্লাহর কাছে আবেদন করে, "হে আল্লাহ, আমার এই পরিকল্পনাকে সফল করে দাও।" এখানে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে নিজের পরিকল্পনাকে। এতে অহংকার প্রবেশের আশঙ্কা থাকে এবং পরিকল্পনাটি যদি আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থী হয়, তবে তা সফল হয় না।


প্রার্থনা করে পরিকল্পনা: এই পদ্ধতিতে মানুষ প্রথমে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সে বলে, "হে আল্লাহ, আমি একটি কাজ করতে চাই। তুমি আমাকে সঠিক পথ দেখাও, আমার জন্য যা কল্যাণকর সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাওফিক দাও এবং তা বাস্তবায়নের জন্য আমাকে সাহায্য কর।" এখানে আল্লাহর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই পথে বরকত থাকে এবং ফলাফল যাই হোক না কেন, মু'মিন ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকে, কারণ সে জানে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকেই নির্ধারিত।


 ইসলাম আমাদের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা করতে নিষেধ করে না, বরং উৎসাহিত করে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টার সূচনা হতে হবে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও তাঁর কাছে প্রার্থনার মাধ্যমে।

🔖মূল সূত্রটি হলো:

দু'আ (প্রার্থনা) + পরিকল্পনা + প্রচেষ্টা = তাওয়াক্কুল (আল্লাহর উপর ভরসা)।


গ. তাওয়াক্কুল (ভরসা) এবং আসবাব (চেষ্টা) এর ভারসাম্য

"প্রথমে প্রার্থনা" করার অর্থ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা নয়। বরং প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহর কাছ থেকে সবুজ সংকেত, মানসিক প্রশান্তি এবং সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়ার পর পূর্ণ উদ্যমে পরিকল্পনা ও চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন:

فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
অর্থ: "অতঃপর যখন তুমি কোনো সংকল্প করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা কর।" (৩:১৫৯) 

প্রথমে প্রার্থনা ও পরামর্শের মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে (আযম) উপনীত হতে হয়, তারপর সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুল করে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।

তাহলে সঠিক ও শোভনীয় পন্থা কোনটি?

একজন মুমিনের জন্য সবচেয়ে সুন্দর ও শোভনীয় পদ্ধতি হলো একটি সমন্বিত পন্থা অবলম্বন করা:

১. প্রথম ধাপ (সার্বিক দু'আ): যেকোনো কাজের শুরুতে সাধারণভাবে আল্লাহর কাছে সাহায্য, হেদায়েত ও বরকতের জন্য দু'আ করা। যেমন—" ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাসতা’ঈন  ইহদিনাস সিরাত্বাল মুস্তাক্বীম- 1:4-5।"

২. দ্বিতীয় ধাপ : কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করার আগে সেই বিষয়ে আল্লাহর কাছে কল্যাণ ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা চেয়ে বিশেষ দু'আ করা।

رَّبِّ اغْفِرْ وَارْحَمْ وَأَنتَ خَيْرُ الرَّاحِمِينَ

রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতা খাইরুর রা-হিমীন। 

🔖 হে আমার রব! ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, আর আপনিই তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু- সূরা আল-মু’মিনূন, 23: ১১৮


৩. তৃতীয় ধাপ (পরিকল্পনা ও চেষ্টা): আল্লাহর উপর ভরসা করে, তাঁর দেওয়া জ্ঞান ও বুদ্ধি ব্যবহার করে সাধ্যমত পরিকল্পনা করা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। কারণ, আল্লাহ চেষ্টার নির্দেশ দিয়েছেন।

رَّبِّ زِدْنِي عِلْمًا

রব্বি যিদনী ইলমা 

হে আমার রব! আমাকে জ্ঞানে বাড়িয়ে দিন-সূরা ত্বহা 20:১১৪ 

৪. চতুর্থ ধাপ (চলমান দু'আ): পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আল্লাহর কাছে সাহায্য, সহজতা ও বরকতের জন্য দু'আ অব্যাহত রাখা।

حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

হাসবুনাল্লা-হু ওয়া নিমাল ওয়াকীল 

আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম! 

সূরা আলে ইমরান 3:১৭৩। 

উপসংহার

"পরিকল্পনা করে প্রার্থনা" করার অর্থ হলো আল্লাহর ইচ্ছাকে আমাদের ইচ্ছার পেছনে চালানো। আর "প্রার্থনা করে পরিকল্পনা" করার অর্থ হলো আমাদের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগামী করা। প্রথমটিতে রয়েছে অহংকার ও অনিশ্চয়তা; দ্বিতীয়টিতে রয়েছে আত্মসমর্পণ, প্রশান্তি ও প্রকৃত সাফল্য।

কোরআনিক জীবনদৃষ্টি আমাদের শেখায়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের আগে স্রষ্টার দরবারে হাজিরা দিতে। তাঁর কাছে পথ চাইতে, আলো চাইতে এবং শক্তি চাইতে। কারণ, তিনিই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। আমাদের কাজ হলো তাঁর পরিকল্পনায় নিজের জন্য একটি সুন্দর ভূমিকা খুঁজে নেওয়া, নিজের পরিকল্পনায় তাঁকে একটি ভূমিকা দেওয়ার চেষ্টা করা নয়।

দুআ: ভিডিও 



Powered by Blogger.