মৎস্য আহরণ: 🐟পেশা যখন ইবাদত। প্রতিটি মাছ আল্লাহর করুণার নিদর্শন। আলকুরআনের শিক্ষায় মৎস্য সম্পদের শুকরিয়া ও সংরক্ষণ

 

কোরআনের আলোকে মাছ ধরা: রিজিক, নিদর্শন ও পরীক্ষার এক গভীর উপাখ্যান🎣

মাছ ধরা—শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে পুকুর বা নদীর ধারে ছিপ হাতে বসে থাকা কোনো শান্ত দৃশ্য, অথবা গভীর সমুদ্রে জাল ফেলে অপেক্ষারত জেলেদের কর্মব্যস্ত মুখ। এটি আমাদের কাছে কেবলই একটি শখ, পেশা অথবা খাদ্যের উৎস। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, আল কোরআন এই সাধারণ কাজটিকেই এক অসাধারণ প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেছে?

কোরআনের দৃষ্টিতে মাছ ধরা নিছক একটি জাগতিক কাজ নয়, বরং এটি আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত, তাঁর অসীম কুদরতের নিদর্শন এবং কখনো কখনো মানুষের ঈমানের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার নাম। চলুন, কোরআনের গভীর অনুধাবনের মাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।

১. আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ: সামুদ্রিক শিকার-নেয়ামত ও হালাল জীবিকা হিসেবে মাছ🐟

আল কোরআন সমুদ্রের শিকারকে মানুষের জন্য একটি বিশেষ হালাল নেয়ামত হিসেবে ঘোষণা করেছে। এমনকি হজ্জের ইহরাম অবস্থায়ও এটি বৈধ।

আল কোরআন সর্বপ্রথম মাছ এবং সামুদ্রিক খাবারকে মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ অনুগ্রহ ও হালাল জীবিকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি আল্লাহর রিজিকের এক বিশাল ভান্ডার, যা তিনি মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।

  • সূরা আল-মায়িদাহ, আয়াত ৯৬:

    তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার এবং তা খাওয়া হালাল করা হয়েছে, তোমাদের এবং ভ্রমণকারীদের ভোগের জন্য।"

    অনুধাবন: এই আয়াতটি একটি মৌলিক ঘোষণা। আল্লাহ সাগর ও তার প্রাণীজগতকে মানুষের খাদ্যের জন্য বৈধ করেছেন। এর গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয় যখন আমরা দেখি যে, হজ্জ বা উমরার ইহরাম অবস্থায় স্থলের প্রাণী শিকার করা নিষিদ্ধ হলেও সমুদ্রের শিকার বৈধ রাখা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সাগর আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ রহমত, যা মানুষের জীবিকাকে সহজ করে দেয়।

আল্লাহর অপার নিয়ামতের স্মরণ:

আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা তাঁর অপার নিয়ামতরাজির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যা তিনি মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেছেন। সমুদ্র ও নদী থেকে প্রাপ্ত সম্পদ এমনই এক বিশাল নিয়ামত। সূরা আন-নাহল-এর ১৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন:

"আর তিনিই সেই সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা গোশত (মাছ) আহার করতে পারো এবং তা থেকে বের করতে পারো অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান করো। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে যা পানি চিরে চলাচল করে, যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো"-16:14

এই আয়াতে বর্ণিত 'তাজা গোশত' বা মাছ আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এক বিশেষ অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আমাদের মৎস্য খাত, যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার উৎস এবং পুষ্টির অন্যতম প্রধান জোগানদাতা।

২. কোরআনের ভাষায় 'তাজা গোশত' 🐟

আল্লাহ মাছকে কোনো সাধারণ খাবার হিসেবে নয়, বরং "লাহমান ত্বরিইয়ান" (لَحْمًا طَرِيًّا) অর্থাৎ "তাজা ও সতেজ গোশত" বলে অভিহিত করেছেন, যা এর পুষ্টি ও বিশুদ্ধতার ইঙ্গিত দেয়।
  • সূরা ফাতির, আয়াত ১২:

    "...আর উভয় (লবণাক্ত ও মিষ্টি পানি) থেকেই তোমরা তাজা গোশত (মাছ) আহার করো..."

    অনুধাবন: এখানে আল্লাহ মিষ্টি ও লবণাক্ত উভয় প্রকার পানি থেকে প্রাপ্ত "তাজা গোশত" বা মাছের কথা উল্লেখ করে তাঁর ব্যবস্থাপনার এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরেছেন। এটি প্রকৃতির ভারসাম্য ও মানুষের জন্য আল্লাহর নিখুঁত পরিকল্পনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

     ৩. কোরআনে ব্যবহৃত মাছের বিভিন্ন নাম🐟

    কোরআনে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মাছের জন্য বিভিন্ন আরবি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে:

    🐟 হূত (حوت): সাধারণ মাছ। সালামুন আলা মূসা এর অলৌকিক ঘটনায় এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

    🐟 হীতান (حيتان): মাছের বহুবচন। শনিবারের বিধান লঙ্ঘনকারী জাতির ঘটনায় এই শব্দটি এসেছে।

    🐟 নূন (نون): একটি বিশেষ বড় মাছ। সালামুন আলা ইউনুস  কে গিলে ফেলা মাছটিকে "নূন" বলা হয়েছে, যার কারণে তাঁর উপাধি হয়েছিল "যুন-নূন" বা "মাছওয়ালা"।

4. আল্লাহর কুদরত ও নিদর্শন হিসেবে মাছ🐟

কোরআনে মাছকে বিভিন্ন নবীর কাহিনীর মাধ্যমে আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

  • সালামুন আলা মূসা ও জীবিত মাছের ঘটনা (সূরা আল-কাহফ):

    মূসা (সা.আ.) যখন আল্লাহর প্রদত্ত এক জ্ঞানী বান্দা-এর সন্ধানে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর সফরের নিদর্শন ছিল একটি মাছ। তাঁদের সাথে থাকা ভাজা মাছটি অলৌকিকভাবে জীবিত হয়ে সমুদ্রে চলে যায়। এই অলৌকিক ঘটনাই তাঁদেরকে সঠিক পথের দিশা দেয়। 

অনুধাবন: এখানে মাছ আল্লাহর এক জীবন্ত নিদর্শন। এটি শেখায় যে, আল্লাহ মৃতকে জীবন দিতে সক্ষম এবং তিনি তাঁর বান্দাদের পথ দেখানোর জন্য এমন সব মাধ্যম ব্যবহার করেন, যা মানুষের কল্পনার অতীত।
  • সালামুন আলা ইউনুস  ও মাছের পেটে আশ্রয় (সূরা আস-সাফফাত):
    সালামুন আলা ইউনুস যখন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে নিজের জাতিকে ছেড়ে চলে যান, তখন তাঁকে একটি বিশাল মাছ গিলে ফেলে। মাছের পেট তাঁর জন্য কারাগার এবং একই সাথে আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। সেখানে তিনি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেন।

অনুধাবন: এই ঘটনায় মাছটি ছিল আল্লাহর নির্দেশের অধীন একটি মাধ্যম। এটি আল্লাহর ক্ষমা, দয়া এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে তাঁর কাছে ফিরে আসার গুরুত্ব তুলে ধরে। মাছের পেট হয়ে উঠেছিল একজন নবীর আত্মশুদ্ধির পাঠশালা।

5. আনুগত্য ও অবাধ্যতার পরীক্ষা হিসেবে মাছ🐟

মাছ ধরার মতো একটি বৈধ কাজও কখনো কখনো মানুষের ঈমান পরীক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

  • ইয়াওমা সাবত পালনকারী জাতির ঘটনা 
    বনী ইসরাইলের একটি সম্প্রদায়কে আল্লাহ ইয়াওমা সাবতি সব ধরনের জাগতিক কাজ, বিশেষ করে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার জন্য আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করলেন যে, ঠিক ইয়াওমা সাবতিই ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ তাদের তীরের কাছে এসে খেলা করত, অথচ অন্য দিনগুলোতে মাছের দেখা পাওয়া যেত না। লোভে পড়ে তারা আল্লাহর আদেশ অমান্য করল এবং বিভিন্ন কৌশলে ইয়াওমা সাবতিই মাছ ধরতে লাগল। এর ফলস্বরূপ, তাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তি নেমে আসে। 
    ( আয়াত ৭:১৬৩-১৬৬ (২:৬৫, ৪:১৫৪)


অনুধাবন: এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি এক শক্তিশালী শিক্ষা দেয়। একটি হালাল কাজও (মাছ ধরা) আল্লাহর আদেশের কারণে হারাম হতে পারে। মূল বিষয় হলো, ব্যক্তিগত লাভ বা লোভের ঊর্ধ্বে উঠে আল্লাহর আদেশের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশ করা। এখানে মাছ ছিল মানুষের ঈমান, ধৈর্য ও সততা যাচাই করার একটি উপকরণ।

কোরআনের গভীর পাঠ আমাদের শেখায় যে, মাছ ধরা নিছক একটি সাধারণ কাজ নয়। এটি একই সাথে:

  • আল্লাহর রিজিক ও নেয়ামত: যা আমাদের কৃতজ্ঞ হতে শেখায়।

  • আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন: যা আমাদের তাঁর ক্ষমতার সামনে বিনয়ী করে।

  • ঈমানের পরীক্ষা: যা আমাদের আনুগত্য ও ধৈর্যশীল হতে অনুপ্রাণিত করে।

চ্যালেঞ্জ ও সংকট

আল্লাহর এই নিয়ামত আজ নানা কারণে হুমকির মুখে।
১. অতিরিক্ত আহরণ: অতিরিক্ত মাছ ধরার ফলে অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।

২. অবৈধ জালের ব্যবহার: কারেন্ট জাল, মশারি জালের মতো অবৈধ জালের ব্যবহারে মাছের পোনা এবং ডিম নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে, যা মৎস্য প্রজননে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে।

৩. নদী দূষণ: শিল্প-কারখানার বর্জ্য এবং কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক নদীর পানিতে মিশে পানিকে বিষাক্ত করে তুলছে, ফলে মাছের প্রাকৃতিক আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে।

৪. জলবায়ু পরিবর্তন: নদীর নাব্যতা হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাব মৎস্য সম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

করণীয় ও সম্ভাবনা:

এই ঐশ্বরিক সম্পদকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

মাছের প্রজনন মৌসুমে (যেমন, ইলিশের ডিম ছাড়ার সময়) মাছ ধরা বন্ধ রাখার আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা নিষিদ্ধ সময়ে অবৈধভাবে মাছ ধরতে বাধ্য না হন।

নদী দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং প্রাকৃতিক অভয়াশ্রমগুলো রক্ষা করতে হবে।

আধুনিক ও টেকসই মৎস্য আহরণ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে জেলেদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করা জরুরি।

শেষ কথা

কোরআনের আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করার পাশাপাশি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও আমাদের দায়িত্ব। মৎস্য সম্পদ তেমনই এক অনুগ্রহ, যার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপায় হলো এর সঠিক পরিচর্যা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। এই নিয়ামতকে রক্ষা করার মাধ্যমেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ রেখে যেতে পারব। এই ঐশ্বরিক দানকে টিকিয়ে রাখা আমাদের সকলের ঈমানী ও নৈতিক দায়িত্ব।

তাই পরের বার যখন কোনো জেলেকে মাছ ধরতে দেখবো  বা নিজে মাছ খাবো, তখন শুধু এর স্বাদ বা পুষ্টির কথাই নয়, এর পেছনের এই গভীর আধ্যাত্মিক শিক্ষাগুলোও স্মরণ করার চেষ্টা করবো। আমাদের চারপাশের প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই আল্লাহ তা'আলা রেখেছেন গভীর শিক্ষা ও নিদর্শন, যা কেবল চিন্তাশীলরাই অনুধাবন করতে পারে।

  ─── ・ 。゚☆: *.☽ .* :☆゚. ───

দুআ-যিকির-তাসবিহ:

আল্লাহর অপার সৌন্দর্য ও নেয়ামত দেখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য পবিত্র কোরআনই আমাদেরকে সর্বোত্তম ভাষা এবং পদ্ধতি শিখিয়েছে। কোরআন অনুধাবনে, শুকরিয়া কেবল একটি অনুভূতি নয়, বরং এটি একটি (conscious) যিকির ও আমল।

এখানে কেবল কোরআনের আয়াত থেকে নেওয়া কিছু তাসবিহ ও যিকির উল্লেখ করা হলো, যা আপনি আল্লাহর সৃষ্টি দেখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পাঠ করতে পারেন।

১. সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বজনীন যিকির: "আলহামদুলিল্লাহ!"

আল্লাহর যেকোনো নেয়ামত, ছোট বা বড়, দেখার পর প্রথম এবং প্রধান যিকির হলো তাঁর প্রশংসা করা। কোরআন এই প্রশংসা দিয়েই শুরু হয়েছে।

যিকির-তাসবিহ:
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
আলহামদু লিল্লা-হি রব্বিল ‘আ-লামীন!
অর্থ: "সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সকল সৃষ্টিজগতের রব (পালনকর্তা)" (১:২, ৬:৪৫, ১০:১০, ৩৭:১৮২, ৩৯:৭৫, ৪০:৬৫)

কখন পড়বেন: যখনই আপনি আকাশ, পৃথিবী, একটি ফুল, একটি শিশু, আপনার সুস্থতা বা যেকোনো নেয়ামতের দিকে তাকাবেন, তখন এই আয়াতটি স্মরণ করুন। এটি স্বীকার করে যে, এই সমস্ত কিছুর উৎস এবং প্রশংসার একমাত্র হকদার হলেন আল্লাহ।

২. আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা: "সুবহানাল্লাহ!"

আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো খুঁত নেই। তাঁর সৃষ্টি কতটা নিখুঁত, সুন্দর এবং বিশাল, তা দেখে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ যিকির।

যিকির-তাসবিহ:
سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ
সুবহা-নাল্ল-হি ‘আম্মা ইয়াসিফূন।
অর্থ: "তারা যা বর্ণনা করে, তা থেকে আল্লাহ কতই না পবিত্র!" (সূরা আল-মু'মিনূন: ৯১)

কখন পড়বেন: যখন আপনি রাতের আকাশে অসংখ্য তারা, সমুদ্রের বিশালতা, পাহাড়ের দৃঢ়তা বা একটি পাখির সুনিপুণ উড্ডয়ন দেখবেন, তখন এই যিকির পাঠ করুন। এটি আল্লাহর শান ও মর্যাদার ঘোষণা, যা মানুষের কল্পনা ও বর্ণনার ঊর্ধ্বে।

৩. কৃতজ্ঞতা ও পবিত্রতার সম্মিলিত যিকির: "তাসবিহ বিহামদিহি"

কোরআন আমাদের আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণার সাথে তাঁর প্রশংসাকেও যুক্ত করতে শিখিয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত শক্তিশালী যিকির।

যিকির-তাসবিহ:
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ
ফাসাব্বিহ বিহামদি রব্বিকা!
অর্থ: "অতএব, আপনি আপনার রবের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন।" (সূরা আল-হিজর: ৯৮ এবং সূরা আন-নাসর: ৩)

কখন পড়বেন: এই যিকিরটি যেকোনো সুন্দর দৃশ্য বা অনুগ্রহ লাভের পর পড়া যায়। এর মাধ্যমে আপনি বলছেন, "হে আমার রব! আপনি যেমন সব খুঁত থেকে পবিত্র (সুবহানাল্লাহ!), তেমনি সকল প্রশংসার যোগ্যও আপনিই (আলহামদুলিল্লাহ!)"

৪. আল্লাহর একত্বের ঘোষণা: "লা ইলাহা ইল্লা হুওয়া"

আল্লাহর সুবিশাল ও সুশৃঙ্খল সৃষ্টিজগতের দিকে তাকালে একজন মু'মিনের হৃদয় তাঁর একত্বের সাক্ষ্য দেয়। এই সৃষ্টিজগতে অন্য কোনো স্রষ্টার অংশীদারিত্ব নেই।

যিকির-তাসবিহ:
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ
আল্ল-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল ক্বইয়্যূম।
অর্থ: "আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক" (2:২৫৫-আয়াতুল কুরসী)

কখন পড়বেন: যখন আপনি সূর্য ও চন্দ্রের সুনির্দিষ্ট গতিপথ, দিন ও রাতের পরিবর্তন বা প্রকৃতির ভারসাম্য দেখবেন, তখন এই আয়াত স্মরণ করুন, যা প্রমাণ করে যে এই মহাবিশ্বের পরিচালক কেবলই এক আল্লাহ।

৫. একটি পূর্ণাঙ্গ কৃতজ্ঞতামূলক দোয়া 

যখন কোনো বড় নেয়ামত বা সফলতা আসে, তখন নবী সুলাইমান (সা:আ.)-এর শেখানো এই দোয়াটি পড়া যেতে পারে। এটি কোরআনের অন্যতম সুন্দর কৃতজ্ঞতামূলক দোয়া।

যিকির-তাসবিহ:
رَبِّ أَوْزِعْنِي أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِي أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَىٰ وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِي بِرَحْمَتِكَ فِي عِبَادِكَ الصَّالِحِينَ

"রব্বি আওযি‘নী আন আশকুরা নি‘মাতাকাল্লাতী আন‘আমতা ‘আলাইয়্যা ওয়া‘আলা ওয়া-লিদাইয়্যা ওয়া আন আ‘মালা স-লিহান তারদ্ব-হু ওয়া আদখিলনী বিরাহমাতিকা ফী ‘ইবা-দিকাস স-লিহীন।"

অর্থ:
"হে আমার রব, আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন যাতে আমি আপনার সেই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা আপনি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছেন এবং এমন সৎকাজ করতে পারি, যা আপনি পছন্দ করেন। আর আপনার দয়ায় আমাকে আপনার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন!" (সূরা আন-নামল: 27:19)

এই যিকির-তাসবিহগুলো আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া কেবল মুখে "ধন্যবাদ" বলার মতো নয়, বরং এটি হলো আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা এবং তাঁর একত্বের স্বীকৃতি দেওয়া।
Powered by Blogger.