একটু গভীরভাবে ভাবুন তো, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে, যদি বাংলাদেশ সরকার কুরবানি নিয়ে কোনো নতুন ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া তো দূরে থাক, শুধু প্রশ্নটিও সামনে আনত কিংবা মরক্কোর মতো একে জনকল্যাণ ও পরিবেশের স্বার্থে কেন্দ্রীভূত করতে চাইত, তাহলে কী হতো? দেশে কী লঙ্কাকাণ্ডই না ঘটে যেত! নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর উস্কানিতে পরিস্থিতি কোন দিকে যেত, তা আল্লাহই ভালো জানেন।
অথচ দেখুন, মরক্কোর মতো একটি প্রভাবশালী, আরবিভাষী, প্রায় শতভাগ মুসলিম এবং ধনী একটি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আমরা কি আল-কুরআনের মূল চেতনাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের প্রথাগত ধারণাকেই ‘প্রকৃত ধার্মিকতা’ ভেবে আত্মপ্রসাদে ভুগছি?
আমাদের দেশের তথাকথিত "সুপারস্টার ওয়াযিনরা" তখন কী করতেন? তারা নিশ্চয়ই এমন এক আবহ তৈরি করতেন যা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তুলত। কারণ এর সাথে তাদের অনেকের ব্যক্তিগত, আর্থিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ‘ধর্মীয়’ স্বার্থ জড়িত (দ্বীনের স্বার্থ নয়)। আসল কথা হলো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা যখন কোনো জাতির কল্যাণ চান, তখন তিনি সেখানকার চিন্তাশীল আলেম এবং শাসকদের মনে কুরআনের আলো প্রবেশ করিয়ে দেন এবং তাদের শুভবুদ্ধির উদয় ঘটান।
হয়তো মরক্কোর শাসকরা উপলব্ধি করেছেন যে, "মিল্লাতে ইব্রাহীম" বা ইব্রাহিম (সা.আ.)-এর আদর্শ অনুসরণের নামে নির্দিষ্ট একটি দিনে একত্রে লক্ষ লক্ষ পশু নিধন করাটা পশু উৎসর্গের চেয়ে পশু হত্যার উৎসবে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে রক্তের এক ভয়াল হলি খেলা।
কুরবানির উদ্দেশ্য কী? কুরআন কী বলে?
কুরবানির মূল উদ্দেশ্য কি এই রক্তের উৎসব? কখনোই না। আল-কুরআন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করে:
لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ
"আল্লাহর কাছে ওগুলোর (কুরবানির পশুর) গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া (আল্লাহভীতি)।" (সূরা আল-হজ্জ, ২২:৩৭)
এখন নিজেদের বিবেককে প্রশ্ন করি, আমাদের সমাজে কি সেই তাকওয়া অর্জিত হচ্ছে? সালমান এফ রহমান বা এস আলমের মতো কোটিপতিদের লক্ষ লক্ষ টাকার কুরবানির পশুর প্রদর্শনীতে কি তাকওয়ার প্রতিফলন ঘটে, নাকি সামাজিক মর্যাদা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা চলে?
কুরবানির সময়কাল: তিন দিন নাকি সম্মানিত মাসগুলো?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো—এই প্রথা কি কুরআনের শাশ্বত বিধানের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ? আল্লাহ যেখানে হজ ও সংশ্লিষ্ট ইবাদতের জন্য চারটি সম্মানিত মাস (الأشهر الحرم)-কে একটি বিস্তৃত ও সুবিধাজনক সময় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন (সূরা আত-তাওবাহ, ৯:৩৬), সেখানে আমরা কারা এই বিধানকে মাত্র তিন দিনে সীমাবদ্ধ করে ফেললাম?
ভেবে দেখুন, যদি কুরবানি এই দীর্ঘ সময়ে করার সুযোগ থাকত, তাহলে:
বছরের একটি বড় অংশ জুড়ে দরিদ্র ও অভাবী মানুষেরা নিয়মিত গোশত বা আমিষের জোগান পেত।
এক দিনে পরিবেশের উপর যে অস্বাভাবিক ও ভয়ংকর চাপ সৃষ্টি হয়, তা হতো না।
তাকওয়া অর্জনের অন্তরালে লোকদেখানোর সুযোগ কমে যেত এবং ইখলাস বা একনিষ্ঠতা বাড়ত।
চূড়ান্ত প্রশ্ন: আমরা কি কুরআন অনুসরণ করছি?
তাহলে কি আল্লাহর রাসূল (সা.আ.) আল-কুরআনের নির্দেশনা অমান্য করে ভিন্ন পথে চলেছেন? (মা’আযাল্লাহ!) এমন প্রশ্ন তোলাও ধৃষ্টতা। বরং প্রশ্নটি আমাদের নিজেদের দিকে—আমরা কি রাসূল (সা.আ.)-এর রেখে যাওয়া কুরআনকে আঁকড়ে ধরেছি, নাকি বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা প্রথাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলেছি?
যা হয়ে গেছে, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে (সূরা বাকারা, ২:২৮৬)। কিন্তু জেনে-বুঝে যদি আমরা আমাদের সন্তান-সন্ততিদেরও এই একই প্রথার দিকে ঠেলে দিই, তাহলে সেই জবাবদিহিতার জন্য আমরা কি প্রস্তুত?
সময় এসেছে, আল-কুরআনের শাশ্বত বিধানকে উপেক্ষা না করে, অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে গভীর চিন্তা ও গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করার।
Leave a Comment