👉 যৌনশিক্ষা ও দাম্পত্য জীবন: ঐসব ভিডিও দেখা কি অনুমোদিত, নাকি গুনাহ? কোরআনের আলোকে বিশ্লেষণ

(একজন প্রশ্নকর্তার জবাব দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই কন্টেন্টটি প্রস্তুত করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম, তাই শেয়ার করলাম)

👉 দাম্পত্য জীবনে যৌনশিক্ষা: শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা কি অনুমোদিত, নাকি গুনাহ? কোরআনের আলোকে বিশ্লেষণ

স্বামী-স্ত্রীর বৈধ মিলনে তৃপ্তি বা প্রশান্তির জন্য সেক্স-সংক্রান্ত সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট আয়াত নেই যা বিস্তারিত কৌশল বর্ণনা করে। তবে, আল-কোরআন বৈবাহিক সম্পর্ককে সামগ্রিকভাবে 'সাকান' (প্রশান্তি), 'মাওয়াদ্দা' (ভালোবাসা) এবং 'রাহমাহ' (দয়া) এর উৎস হিসেবে বর্ণনা করেছে। এই প্রশান্তি এবং ভালোবাসা অর্জনের একটি অংশ হলো শারীরিক ও মানসিক ঘনিষ্ঠতা।

একটি ভিডিও/অডিও নিচের দিকে দ্র: 

যে আয়াতগুলো এই সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্য এবং ব্যাপকতাকে তুলে ধরে, সেগুলো থেকেই তৃপ্তি ও প্রশান্তির বিষয়টি অনুধাবন করা যায়:

১. সূরা রুম (৩০) আয়াত ২১:

"আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি (سَكَنٌ) লাভ করো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা (مَوَدَّةً) ও দয়া (رَحْمَةً) সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে।"

🔗অনুধাবন: 

এই আয়াতটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। 'সাকান' বা প্রশান্তি কেবল মানসিক নয়, বরং শারীরিক ও আত্মিক শান্তিকেও বোঝায়। পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়ার মাধ্যমে এই প্রশান্তি আসে, যার মধ্যে সঙ্গমের মাধ্যমে অর্জিত তৃপ্তিও অন্তর্ভুক্ত। এই তৃপ্তি মূলত সম্পর্ককে আরও গভীর ও সুন্দর করে তোলে।

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক শুধুমাত্র জৈবিক প্রয়োজন পূরণের জন্য নয়, বরং এটি মানসিক প্রশান্তি, ভালোবাসা এবং দয়ার এক গভীর বন্ধন। এই সম্পর্ককে মজবুত ও তৃপ্তিদায়ক করার জন্য উভয়েরই দায়িত্ব রয়েছে।

2. "তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পোশাক এবং তোমরা (স্বামীগণ) তাদের পোশাক।" সূরা বাকারা (২) আয়াত ১৮৭:

🔗অনুধাবন: 

'পোশাক' উপমাটি দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের জন্য আবরণ, সুরক্ষা, সম্মান, এবং সৌন্দর্য। পোশাক যেমন মানুষের গোপন বিষয় ঢেকে রাখে, তেমনি স্বামী-স্ত্রীও একে অপরের জন্য মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে পূর্ণাঙ্গ আশ্রয়স্থল। এই আয়াতটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীরতম ঘনিষ্ঠতা এবং পারস্পরিক নির্ভরতাকে ইঙ্গিত করে, যেখানে কোনো গোপনীয়তা থাকে না এবং একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ উন্মোচিত হওয়ার মাধ্যমে তৃপ্তি ও প্রশান্তি লাভ করা যায়। এই ঘনিষ্ঠতার মধ্যে শারীরিক মিলনও অন্তর্ভুক্ত, যা তাদের পোশাকের মতো একে অপরের জন্য স্বস্তি ও পূর্ণতা দেয়।

3. কোরআনে বৈধ যৌন সম্পর্কের অনুমোদন:

আল কোরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে বৈধ বিবাহ সম্পর্কের মধ্যে শারীরিক মিলন অনুমোদিত। উদাহরণস্বরূপ—

সূরা আল-মুমিনুন (২৩:৫-৬):

“এবং যারা, তারা তাদের লজ্জাস্থানসমূহের ব্যাপারে সংরক্ষণকারী; তাদের দাম্পত্যসাথীদের ক্ষেত্রে ব্যতীত অথবা তাদের ডানহাত যা অধিকার করেছে। তখন অবশ্য তারা নিন্দিত নয়।”

এ আয়াত প্রমাণ করে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌনসম্পর্ক অনুমোদিত এবং এতে কোনো গুনাহ নেই। বরং এটি স্বাভাবিক ও বৈধ।

কোরআনে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্যের কথা উল্লেখ থাকলেও, সহবাসের নির্দিষ্ট পদ্ধতি বা কৌশল নিয়ে সরাসরি কোনো বিস্তারিত আলোচনা নেই। তবে, কোরআন শালীনতা, লজ্জা এবং তাকওয়া বজায় রাখার উপর জোর দেয়। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে তাদের লজ্জাস্থান হেফাযত করার নির্দেশ দিয়েছেন, তবে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়, কারণ তাদের জন্য একে অপরের কাছে কোনো গোপনীয়তা নেই।

"হেফাজত" মানে কী?

“হিফাজত” বা "حفظ" শব্দের আরবি অর্থ হলো—

📍সংরক্ষণ করা-

📍নিয়ন্ত্রণ করা-

📍সঠিক সময়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করা-

অতএব, লজ্জাস্থান হেফাজত মানে:

১. এটিকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান দেওয়া।

২. অপব্যবহার (ব্যভিচার, পর্নোগ্রাফি, অবৈধ সম্পর্ক) থেকে বাঁচানো।

৩. এবং আল্লাহ প্রদত্ত বৈধ কাঠামোতে (বিবাহে) ব্যবহার করা, যাতে মানবজীবনের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক প্রয়োজন পূর্ণ হয়।

4. সূরা বাকারার ২২৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:

"তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র। অতএব, তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেভাবে ইচ্ছা গমন করো।" (২:২২৩)

এই আয়াতটি মূলত সঙ্গমের বৈধতা ও প্রশস্ততার একটি স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। 'শস্যক্ষেত্র' উপমা দ্বারা স্ত্রীর গর্ভকে বোঝানো হয়েছে, যা সন্তান উৎপাদনের ক্ষেত্র। 'যেভাবে ইচ্ছা গমন করো' এই অংশটি দ্বারা নাযিলকৃত আয়াতে নিষিদ্ধ নয় এমন যেকোনো বৈধ পদ্ধতিতে সঙ্গমের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সন্তুষ্টি ও তৃপ্তির জন্য সহায়ক। এটি যৌন মিলনের স্বাধীনতাকে নির্দেশ করে, যা পারস্পরিক তৃপ্তি ও আনন্দ অর্জনে ভূমিকা রাখে, যতক্ষণ না তা হারাম কোনো পন্থায় হয় (যেমন পায়ুপথে মিলন)।

5. জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে কোরআনের দিকনির্দেশনা:

কোরআনে বারবার বলা হয়েছে—মানুষ যেন জ্ঞান অর্জন করে, চিন্তা-ভাবনা করে এবং নিজের উপকারের জিনিস শিখে নেয়।

“পড়! তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আলাক থেকে।...যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের মাধ্যমে। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না-সূরা আল আলাক্ব ৯৬:১-৬।”

এখান থেকে স্পষ্ট হয় যে জ্ঞান অর্জন করা ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে, যতক্ষণ না তা হারাম কোনো পথে নিয়ে যায়।

6. সমস্যার জায়গা: ভিডিওর ধরণ:

এখন মূল প্রশ্ন হলো—“শিক্ষামূলক ভিডিও” বলতে কী বোঝানো হচ্ছে?

যদি ভিডিওগুলো অশ্লীল বিনোদনমূলক পর্নোগ্রাফি হয়ে থাকে, তবে তা স্পষ্টভাবে কোরআনের নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। কারণ, কোরআনে চোখ ও লজ্জাস্থান হিফাজতের নির্দেশ এসেছে (সূরা আন-নূর ২৪:৩০-৩১)।

কিন্তু যদি ভিডিওগুলো একেবারেই চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও বৈধ দাম্পত্য শিক্ষার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় (যেমন মেডিকেল বা এডুকেশনাল অ্যানিমেশন, ডাক্তারদের স্বাস্থ্য-শিক্ষামূলক কন্টেন্ট), তবে কোরআনের আলোকে এটিকে সরাসরি গুনাহ বলা যায় না। কারণ উদ্দেশ্য যদি হয় বৈধ মিলনে স্বচ্ছতা ও সুস্থতা আনা, তবে তা জ্ঞানার্জনের মধ্যে পড়ে।

তবে, আধুনিক শিক্ষামূলক ভিডিও দেখার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন:

১. উদ্দেশ্য: যদি উদ্দেশ্য হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ককে আরও সুন্দর, তৃপ্তিদায়ক ও সুদৃঢ় করা এবং নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়ানো, তবে তা বৈধ হতে পারে। এটি যদি নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক অধিকার পূরণের মাধ্যম হয়, তবে তা প্রশংসনীয়।

২. পরিবেশ ও শালীনতা: ভিডিওর বিষয়বস্তু যেন অশ্লীলতা বা বিকৃত রুচির প্রচারক না হয়। শিক্ষামূলক ভিডিওর নামে যদি তা কেবল উত্তেজনা সৃষ্টিকারী বা বাজারের সস্তা পণ্যের মতো হয়, তবে তা পরিহার করা উচিত।

৩. বিশ্বস্ত উৎস: যে উৎস থেকে ভিডিও দেখা হচ্ছে, তা কতটা নির্ভরযোগ্য এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তা যাচাই করা উচিত। পশ্চিমা বা বিধর্মীয় সংস্কৃতির কোনো ভিডিও যদি ইসলামী শালীনতাবোধের পরিপন্থী হয়, তা এড়িয়ে চলা উচিত। এক্ষেত্রে, ইসলামসম্মত জীবনযাপন ও সম্পর্কের উপর গুরুত্বারোপকারী উৎস থেকে শেখা উত্তম।

৪. গোপনীয়তা: স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। এই ধরনের ভিডিও দেখে শেখার পর তা যেন অন্য কারো কাছে প্রকাশ না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

📖 সূরা আল-আরাফ (৭:৩৩)

“বলুন, আমার প্রতিপালক কেবল অশ্লীল কাজকে হারাম করেছেন—তা প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন, এবং পাপাচার, অন্যায় সীমালঙ্ঘন, আল্লাহর সাথে শিরক, এবং এমন কিছু বলা যার কোনো জ্ঞান তোমাদের নেই।”

🔎 এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করেছেন—সব ধরণের অশ্লীল কাজ (যা যৌন সম্পর্কিত হোক বা অন্য ধরনের) প্রকাশ্য ও গোপন—সবই নিষিদ্ধ।

---

অর্থ কী দাঁড়ায়?

অশ্লীল দৃশ্য, কথা, বা কাজ—হোক সেটা প্রকাশ্যে (সবার সামনে) কিংবা গোপনে (নিজে নিজে)—সবই হারাম।

এর অন্তর্ভুক্ত হলো: পর্নোগ্রাফি দেখা, অশ্লীল ভিডিও তৈরি/শেয়ার, গোপনে এমন কিছু উপভোগ করা যা আল্লাহ নিষিদ্ধ করেছেন।

তবে বৈধ দাম্পত্য সম্পর্কে যা ঘটে, তা অশ্লীলতার মধ্যে পড়ে না, কারণ কোরআন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে বৈধ করেছে (সূরা আল-মুমিনুন ২৩:৫-৬)।

---

👉 তাহলে সারসংক্ষেপ:

আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন—অশ্লীলতা গোপন বা প্রকাশ্যে যেভাবেই হোক, নিষিদ্ধ।

কিন্তু দাম্পত্য জীবনে বৈধ যৌনসম্পর্ক এবং সেই সম্পর্ক সুন্দরভাবে বজায় রাখার জ্ঞান অর্জন—সেটি ভিন্ন বিষয়। মূল পার্থক্য হলো: অশ্লীলতা বনাম বৈধ জ্ঞান।

কোরআনের মূল বার্তা: কোরআন দম্পতিদের মধ্যে প্রেম, প্রজ্ঞা, দয়া এবং পারস্পরিক সম্মানের উপর গুরুত্ব দেয়। যদি শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা এই সম্পর্ককে আরও উন্নত ও আনন্দদায়ক করতে সাহায্য করে এবং ইসলামী মূল্যবোধের পরিপন্থী না হয়, তবে তা অবৈধ হওয়ার কোনো স্পষ্ট কারণ কোরআনে পাওয়া যায় না। তবে, সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ রাখা এবং তাঁর সীমালঙ্ঘন না করা অপরিহার্য।

উপসংহারে বলা যায়, কোরআন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের পবিত্রতা ও প্রশান্তির উপর জোর দেয়। যদি শিক্ষামূলক ভিডিও স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বোঝাপড়া ও তৃপ্তিকে শালীনভাবে বাড়াতে সাহায্য করে এবং তা ইসলামী নৈতিকতার সীমার মধ্যে থাকে, তবে তা গুনাহ হবে না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, নিজেদের মধ্যে ভালোবাসা ও সম্মান বজায় রেখে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

যৌনতাই যে জীবনের সব নয়, প্রমান-  আল-কুরআনে স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ককে অটুট, দয়া ও মমতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একটি বন্ধন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে সালামুন আলা ইব্রাহীম  ও তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী এর ঘটনা কুরআনে সূরা হুদে ১১:৭১-৭২ আয়াতে এসেছে। সুতরাং ধৈর্য ধারন করুন! স্বামী-স্ত্রীর বৃদ্ধতা মেনে নেয়াই কুরআনে  উল্লেখিত সূন্নাহ।

আল্লাহু আ’লামু (আল্লাহই অধিক জ্ঞাত)-৬:১২৪

আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন!

একটি ভিডিও/অডিও