নবী ও রাসূলের মধ্যে পার্থক্য কী? — কুরআনের আলোকে একটি বিশ্লেষণ Prophets and Messengers?
নবী ও রাসূল: আল কুরআনের আলোকে তাদের পরিচয় ও পার্থক্য?
নবী (نبيّ) ও রাসূল (رسول) — এ দুটি পরিভাষা ইসলামী শাস্ত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও অনেকেই তাদের মাঝে পার্থক্য ঠিকভাবে বোঝেন না। কেবলমাত্র আল-কুরআনের আলোকে আমরা যদি এ বিষয়ে অনুসন্ধান করি, তাহলে একটি স্পষ্ট ও পরিশুদ্ধ ধারণা পাওয়া সম্ভব। এই ব্লগ পোস্টে আমরা কুরআনের ভাষা, শব্দব্যবহার ও প্রাসঙ্গিক আয়াতের আলোকে নবী ও রাসূলের পরিচয় ও পার্থক্য তুলে ধরবো।
🔹 ১. অর্থগত পার্থক্য: (কোরআনের ভাষায়)
পদ | আরবি | মূল ধাতু | অর্থ |
---|---|---|---|
নবী | نبيّ | نبأ (নাবা) | সংবাদদাতা, আল্লাহর ওহি প্রাপ্ত |
রাসূল | رسول | رسل (রসালা) | বার্তাবাহক, প্রেরিত ব্যক্তি |
🖼️ দৃষ্টি আকর্ষণ: এতে ব্যবহৃত চিত্রসমূহ প্রতীকী মাত্র।
🟩 ২. কোরআনে নবী ও রাসূল — পৃথক শব্দ:
সূরা আল-হাজ্জ (২২:৫২):
"তোমার আগে আমরা কোনো রাসূল বা নবী পাঠাইনি..."
🔍 আলাদা করে নবী ও রাসূল শব্দ ব্যবহার করায় বোঝা যায়, এই দুটির মাঝে পার্থক্য রয়েছে।
🟩 ৩. কোরআনের আলোকে মূল পার্থক্য:
বৈশিষ্ট্য | নবী (نبيّ) | রাসূল (رسول) |
---|---|---|
ওহি পায় | ✅ হ্যাঁ | ✅ হ্যাঁ |
নতুন কিতাব প্রাপ্ত | ❌ না | ✅ হ্যাঁ |
পূর্ববর্তী কিতাব অনুসরণ করে | ✅ হ্যাঁ | ❌ না |
দায়িত্ব সীমাবদ্ধ | ✅ নিজ জাতি | ✅ নিজ জাতি |
বার্তা পৌঁছানো বাধ্যতামূলক | আংশিক | পূর্ণ |
শাস্তি কার্যকর হয় | ❌ না | ✅ অনেক সময় হয় |
✅ সূরা আল-মায়েদা (৫:৪৪):
"...তাওরাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো; এর দ্বারা বিচার করতেন নবীগণ..."
🔍 নবীরা নতুন কিতাব আনতেন না, বরং পূর্ববর্তী কিতাব অনুসরণ করে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতেন।
✅ সূরা ইবরাহিম (১৪:৪):
"আমি কোনো রাসূলকেই পাঠাইনি তার কওমের ভাষা ছাড়া..."
🔍 রাসূলকে নির্দিষ্ট জাতির ভাষাভাষী হিসেবে মনোনীত করা হয় যেন তিনি সঠিকভাবে বার্তা পৌঁছাতে পারেন।
✅ সূরা আহযাব (৩৩:৪০):
"মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী।"
🔍 এখানে রাসূল ও নবী দুই পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে; নবী হিসেবে তাঁকে শেষ বলা হয়েছে, রাসূল হিসেবে নয়।
🟩 ৪. নবী ও রাসূল কি আল্লাহই মনোনীত করেন?
নবী ও রাসূল মনোনয়নে একমাত্র কর্তৃত্ব আল্লাহর
🔹 ১. আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাসূল মনোনীত করেন
সূরা আল-হাজ্জ (২২:৭৫):
اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ
“আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে রাসূল মনোনীত করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদর্শী।”
🔍 এখানে "يَصْطَفِي" অর্থাৎ মনোনীত করেন — এটি স্পষ্ট করে দেয় যে রাসূল হওয়া কোনো ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নির্বাচিত হওয়া।
🔹 ২. নবুওত দানের মালিক একমাত্র আল্লাহ
সূরা আলে ইমরান (৩:৭৯):
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُؤْتِيَهُ اللَّهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ...
“কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, বিধান এবং নবুয়ত দান করবেন...”
🔍 এই আয়াত প্রমাণ করে, নবুয়ত কেবলমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে, এটি মানুষের কোনো উদ্যোগের ফল নয়।
🔹 ৩. রাসূল প্রেরণ—আল্লাহর একক সিদ্ধান্ত
সূরা আন-নাহল (১৬:২):
يُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ بِالرُّوحِ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ...
“তিনি তাঁর আদেশ অনুযায়ী ফেরেশতা প্রেরণ করেন রূহ (ওহী) নিয়ে, যাকে ইচ্ছা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে।”
🔍 “عَلَىٰ مَن يَشَاءُ” অর্থাৎ যাকে ইচ্ছা — এটি নির্দেশ করে যে রাসূলত্ব আল্লাহর নির্বাচনের বিষয়, এতে কারো নিজস্ব আগ্রহ বা প্রচেষ্টার ভূমিকা নেই।
🔹 ৪. ওহী প্রদানের মাধ্যমেই নবী হওয়া সম্ভব
সূরা আশ-শুরা (৪২:৫১):
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا...
“কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যে আল্লাহ তার সঙ্গে কথা বলেন, তবে ওহীর মাধ্যমে...”
🔍 এই আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, নবী হওয়া একান্তই ওহীপ্রাপ্ত হওয়ার মাধ্যমে ঘটে—এটি কোনো ব্যক্তির নিজ প্রচেষ্টার দ্বারা সাধিত হয় না।
🔹 ৫. বার্তা কার ওপর নাযিল হবে, তা আল্লাহই ভালো জানেন
সূরা আল-আন'আম (৬:১২৪):
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
“আল্লাহ ভালো জানেন, কার ওপর তাঁর বার্তা অর্পণ করবেন।”
🔍 এখানে আল্লাহ স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, রিসালতের উপযুক্ততা নির্ধারণ একান্তই তাঁর জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল।
আল-কুরআনের আলোকে সুস্পষ্টভাবে বলা যায়— নবী ও রাসূল আল্লাহ নিজেই মনোনীত করেন। এটি মানুষের কোনো প্রচেষ্টা, যোগ্যতা বা আকাঙ্ক্ষার দ্বারা অর্জনযোগ্য নয়। বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য।
✅ সূরা আল-বাকারা (২:২৫৩):
"এই রাসূলগণের মধ্যে আমি একদলকে অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি..."
➡️ প্রমাণ করে, সব রাসূল সমান নন — আল্লাহ নিজ ইচ্ছানুযায়ী শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করেন।
✅ সূরা আশ-শু'আরা (২৬:১৯৮–২০০):
"...আর আমরা যদি কুরআনকে কোনো অ-আরবের ভাষায় করতাম, তবে তারা বলত, এর আয়াতগুলো বিশদ নয় কেন?"
➡️ প্রমাণ করে রাসূল নিজ জাতির ভাষায় প্রেরিত হন। এটি আল্লাহর পরিকল্পিত নির্বাচন।
✅ সূরা আলে ইমরান (৩:৬):
"তিনি গর্ভে তোমাদের আকৃতি দেন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেন।"
➡️ আল্লাহ যেভাবে চান, সেভাবেই নবী-রাসূলদের সৃষ্টি ও মনোনয়ন করেন।
🟩 ৫. রাসূল সবসময় মানুষ নয় — ফেরেশতা ও অন্যান্য দূতদের প্রতিও প্রয়োগ:
রাসূল শব্দটি কেবল মানবপ্রেরিতদের জন্যই নয়, ফেরেশতা বা অন্য সৃষ্টির প্রতিও ব্যবহৃত হয়েছে।
✅ সূরা মারইয়াম (১৯:১৯):
قَالَ إِنَّمَا أَنَا۠ رَسُولُ رَبِّكِ...
“সে বলল, ‘আমি তোমার প্রভুর এক রাসূল...’”
🔍 এখানে সালামুন আলা জিবরাঈল নিজেকে রাসূল বলেছেন — যদিও তিনি মানুষ নন।
✅ সূরা হূদ (১১:৬৯):
“নিশ্চয়ই আমাদের রাসূলগণ ইবরাহিমের কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছিল...”
🔍 এই আয়াতে ‘রাসূলগণ’ বলতে ফেরেশতাদের বোঝানো হয়েছে, যারা সালামুন আলা লূত-এর জাতির ধ্বংস বার্তা ও সুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন।
📌 অর্থাৎ কোরআনে ‘রাসূল’ মানেই শুধু মানুষ নয় — বরং “বার্তা বহনকারী” হিসেবে ফেরেশতাও এই পদবি পেতে পারেন।
✅ সূরা ফুরকান (২৫:২০):
وَمَا أَرْسَلْنَا قَبْلَكَ مِنَ ٱلْمُرْسَلِينَ إِلَّآ إِنَّهُمْ لَيَأْكُلُونَ ٱلطَّعَامَ وَيَمْشُونَ فِى ٱلْأَسْوَاقِ...
“তোমার পূর্বে যেসব রাসূল প্রেরণ করেছি, তারা সবাই খাবার খেতেন ও বাজারে চলাফেরা করতেন।”
🔍 এই আয়াতে বোঝা যায়, মানুষরূপে প্রেরিত রাসূলদের আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়েছে — অর্থাৎ রাসূল সবসময় মানুষ না-ও হতে পারে।
📝 সংক্ষিপ্ত তুলনা:
প্রশ্ন | নবী | রাসূল |
---|---|---|
ওহি পায়? | ✅ | ✅ |
নতুন কিতাব আনে? | ❌ | ✅ |
পূর্ববর্তী কিতাব মানে? | ✅ | ❌ |
শুধু নিজ জাতির জন্য? | ✅ | ✅ |
বার্তা পৌঁছানো বাধ্যতামূলক? | আংশিক | পূর্ণ |
অস্বীকৃতির পর শাস্তি আসে? | ❌ | ✅ |
সবসময় মানুষ? | ✅ | ❌ (ফেরেশতা হতে পারেন) |
🔄 উপসংহার:
আল কুরআনের আলোকে:
-
নবী হলেন এমন ওহি প্রাপ্ত বান্দা, যিনি পূর্ববর্তী কিতাব ও শরিয়তের অনুসরণকারী এবং মানুষকে সঠিক পথে ফেরানোর দায়িত্ব পালন করেন।
-
রাসূল হলেন এমন একজন নবী অথবা ফেরেশতা, যিনি নতুন কিতাব ও শরিয়ত নিয়ে আগমন করেন অথবা বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্বে প্রেরিত হন। মানুষের মধ্য থেকে রাসূল নির্বাচিত হলেও কুরআনে ফেরেশতা রাসূল হিসেবেও উল্লেখিত হয়েছেন।
📌 নবুয়ত ও রিসালত — উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে মনোনীত। কারও চেষ্টায় বা সাধনায় তা অর্জিত হয় না।
Leave a Comment