আমি? আমরা? আমাদের? না-কি সব একজনেরই মাত্র! কোন কিছুই যে শুধুই আমার নয়- কী বলেন আমাদের সবার রব?

এই প্রশ্নের উত্তরে ইসলাম দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করে যে, সবকিছুর প্রকৃত মালিকানা একমাত্র আল্লাহ তাআলার। "আমি", "আমরা", বা "আমাদের" বলে যা কিছুকে আমরা সম্বোধন করি, তার উপর আমাদের অধিকার বা মালিকানা নিতান্তই সাময়িক, সীমিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত একটি আমানত মাত্র।

আল কোরআন মাজিদে বহু আয়াতে এই সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে:

১. সার্বভৌম মালিকানা আল্লাহর:

 "আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই।" (সূরা আল-বাকারা, ২:২৮৪)

 "জেনে রাখ, আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর। জেনে রাখ, আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না।" (সূরা ইউনুস, ১০:৫৫)

 "আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। আসমানসমূহে যা আছে এবং যমীনে যা আছে সব তাঁরই।" (সূরা ত্বা-হা, ২০:৬)

২. মানুষ আল্লাহর খলিফা (প্রতিনিধি) ও আমানতদার:

পৃথিবীতে মানুষকে আল্লাহ তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেছেন এবং বিভিন্ন নিয়ামতরাজি ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন। এগুলো আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও আমানত।

* "আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি যমীনে খলীফা সৃষ্টি করতে যাচ্ছি’।" (সূরা আল-বাকারা, ২:৩০)

* "তিনিই তোমাদেরকে যমীনে খলীফা বানিয়েছেন।" (সূরা ফাতির, ৩৫:৩৯)

"পৃথিবীতে সব নেয়ামতরাজী সবার জন্যই সব- কোন কিছুই যে শুধুই আমার নয়- কী বলেন আমাদের সবার রব?"

আপনার এই উপলব্ধি ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে যে অগণিত নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন, তা সমগ্র মানবজাতি এবং সকল সৃষ্টির জন্য। যদিও ব্যক্তিগত ব্যবহারের ও উপার্জনের অনুমতি রয়েছে, তবে এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য সমষ্টিগত কল্যাণ এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করা।


আল কোরআনে  এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে:

১. রিযিক ও নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে:

* "আর যমীনে বিচরণকারী এমন কোন জীব নেই, যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর নেই।" (সূরা হুদ, ১১:৬)

* "এবং তিনি তোমাদেরকে তোমাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করলে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অতিমাত্রায় যালিম, অকৃতজ্ঞ।" (সূরা ইবরাহীম, ১৪:৩৪)

"সবাই সবার জন্য – এই নীতির একটি অনন্য উদাহরণ আধুনিক সমাজেও দেখা যায়। দেখুন এই ভিডিওতে"

মানুষের অবস্থান ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব:

তাহলে মানুষ হিসেবে আমাদের অবস্থান কী? আমরা কি সত্যিই স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ? কুরআন আমাদের জানায়:

সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২৬:

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَاءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

"বলুন! হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান।"

অনুধাবন: এই আয়াতে রাজত্ব, সম্মান, অপমান সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছাধীন বলা হয়েছে। মানুষের কোনো কিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। যা কিছু আমরা অর্জন করি, তা আল্লাহরই ইচ্ছায়। সুতরাং, 'আমি করেছি' বলার চেয়ে 'আল্লাহ করিয়েছেন' বলাই অধিকতর সঙ্গত।

সূরা ফাতির, আয়াত ১৫:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ أَنتُمُ الْفُقَرَاءُ إِلَى اللَّهِ ۖ وَاللَّهُ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ

"হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী (ফকির); আর আল্লাহ, তিনিই অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত।"

অনুধাবন: মানুষ যে আল্লাহর করুণার কাঙাল এবং আল্লাহ যে সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী, তা এই আয়াতে স্পষ্ট। যার নিজের কিছুই নেই, সে-ই তো ফকির। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস, প্রতিটি মুহূর্ত তাঁরই দয়ায় চলে।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত:

এই উপলব্ধি যখন অন্তরে প্রোথিত হয়, তখন একজন বিশ্বাসীর জীবন কেমন হওয়া উচিত? তার জীবনের প্রতিটি কর্ম কার জন্য নিবেদিত হবে?- 6:162

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

"আমার সলাত ও আমার ত্যাগ এবং আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের রব আল্লাহর জন্য"

অনুধাবন: এই আয়াতে একজন মুমিনের জীবনের প্রতিটি দিক – তার ইবাদত, ত্যাগ, এমনকি তার জীবন ও মৃত্যু – সবকিছুই আল্লাহর জন্য উৎসর্গীকৃত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখানে 'আমি'র অহংকার চূর্ণ হয়ে যায় এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের চিত্র ফুটে ওঠে। যখন জীবনটাই আল্লাহর, তখন জীবনের অংশবিশেষ 'আমার' বলে দাবি করার কোনো অর্থ থাকে না।

পরিশেষে, রাজত্ব ও ক্ষমতার চূড়ান্ত উৎস কে?

সূরা আল-মুলক, আয়াত ১:

تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

"বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে রাজত্ব। আর তিনি সবকিছুর উপর সর্বশক্তিমান।"

অনুধাবন: এই সূরার নামই 'রাজত্ব'। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে সমস্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা আল্লাহর হাতে। আমরা কেবল তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে কিছু দায়িত্ব পালন করি। সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২৮৪:

لِّلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ وَإِن تُبْدُوا مَا فِي أَنفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُم بِهِ اللَّهُ

"আসমানসমূহে যা আছে এবং পৃথিবীতে যা আছে সব আল্লাহরই। তোমরা তোমাদের মনে যা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ তোমাদের কাছ থেকে তার হিসাব নেবেন।"

অনুধাবন: এই আয়াতেও মালিকানার কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে। এমনকি আমাদের মনের গভীরে লুকানো চিন্তাগুলোও তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। এতে বোঝা যায়, আমাদের উপর তাঁর কর্তৃত্ব কতখানি ব্যাপক।

২. সম্পদে অন্যের অধিকার:

ইসলাম সম্পদে গরিব, মিসকিন ও অভাবীদের অধিকার নিশ্চিত করেছে সাদকার মাধ্যমে। এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের অর্জিত সম্পদে কেবল আমাদের একচ্ছত্র অধিকার নেই, বরং সমাজের বঞ্চিতদেরও হক রয়েছে।

* "আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার।" (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:১৯)

* "সাদাকা তো কেবল ফকীর, মিসকীন, আদায়কারী কর্মচারী, যাদের অন্তর অনুরাগী করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। আর আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা আত-তাওবা, ৯:৬০)

৩. অপচয় ও অহংকার থেকে বিরত থাকা:

যেহেতু নিয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত, তাই এর অপচয় করা বা তা নিয়ে অহংকার করা নিষিদ্ধ।

* "এবং আহার কর ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে ভালবাসেন না।" (সূরা আল-আ‘রাফ, ৭:৩১)

* "আর তুমি যমীনে দম্ভভরে চলো না। নিশ্চয় তুমি কখনো যমীনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনো পাহাড় সমান পৌঁছতে পারবে না।" (সূরা আল-ইসরা, ১৭:৩৭)

৪. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও আল্লাহর পথে ব্যয়:

আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা এবং তা তাঁর নির্দেশিত পথে ব্যয় করাই মুমিনের কর্তব্য।

* "অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। আর তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না"-২:১৫২

* "যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাতে ও দিনে, গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের প্রতিদান তাদের রব-এর নিকট রয়েছে। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না"-২:২৭৪

উপসংহার ও জীবনের উপলব্ধি:

কুরআনের এই আয়াতগুলো থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, তা হলো – আমাদের গর্ব করার মতো নিজস্ব কিছুই নেই। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, সামর্থ্য, সম্পদ, এমনকি আমাদের এই জীবন – সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত। তিনি যখন ইচ্ছা তা ফিরিয়ে নিতে পারেন। এই উপলব্ধি আমাদের আত্ম-অহংকার থেকে মুক্তি দেয়, আমাদের বিনয়ী হতে শেখায় এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করে।

তখন "আমি বলতে কিছু নাই, সবই যে আল্লাহর" – এই কথাটি শুধু মুখের বুলি থাকে না, বরং তা পরিণত হয় জীবনযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে। আমরা তখন নিজেদের সকল সাফল্যকে আল্লাহর রহমত হিসেবে দেখি এবং ব্যর্থতায় ধৈর্য ধারণ করে তাঁরই সাহায্য কামনা করি। এই উপলব্ধির মাঝেই নিহিত রয়েছে একজন মুমিনের জীবনের প্রকৃত প্রশান্তি ও সাফল্য।

বস্তুত, 'আমি', 'আমরা' বা 'আমাদের' – এই শব্দগুলোর আপেক্ষিক অর্থ থাকলেও, পরম অর্থে সবকিছুর একচ্ছত্র মালিকানা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব শুধুই মহান আল্লাহ তা'আলার। আর এই মহাসত্যকে মেনে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে মানবজাতির কল্যাণ।

Video:


Powered by Blogger.