আপনজনের জুলুম ও কষ্টদায়ক আচরণ: করণীয়? 🔔
আপনজনের জুলুম ও কষ্টদায়ক আচরণ: কোরআনের আলোকে মুমিনের করণীয়:
➥ প্রথম ধাপ: ধৈর্যের সৌন্দর্য ও ক্ষমার মহত্ত্ব
ক্রোধ সংবরণ ও ক্ষমা: কোরআন রাগ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমা করাকে মুত্তাকিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করেছে।সূরা আল ইমরান (৩), আয়াত ১৩৪: "...যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল। আর আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালোবাসেন।"ক্ষমা করা দৃঢ় সংকল্পের কাজ: ক্রোধান্বিত অবস্থায়ও ক্ষমা করতে পারা মুমিনের ঈমানের পরিচায়ক।সূরা আশ-শূরা (৪২), আয়াত ৩৭: "এবং যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যাবলী থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন ক্রোধান্বিত হয়, তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।"ক্ষমার পুরস্কার আল্লাহর কাছে: যিনি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করেন এবং সম্পর্ক নিষ্পত্তির চেষ্টা করেন, তার জন্য আল্লাহর কাছে মহাপুরস্কার রয়েছে।সূরা আশ-শুরা (৪২), আয়াত ৪০: "মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। তবে যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে আছে। নিশ্চয় তিনি জালিমদের পছন্দ করেন না।"পরিবারের প্রতি বিশেষ ক্ষমা: আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে ক্ষমা ও উদারতাকে উৎসাহিত করেছেন।সূরা আত-তাগাবুন (৬৪), আয়াত ১৪: অর্থ: "হে মুমিনগণ! তোমাদের স্ত্রী-স্বজন ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। অতএব তাদের সম্পর্কে তোমরা সতর্ক থেকো। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং ক্ষমা কর, তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু।"
➥দ্বিতীয় ধাপ: মন্দের জবাবে উত্তম আচরণ করা
সূরা ফুসসিলাত (৪১), আয়াত ৩৪: "সৎকাজ ও অসৎকাজ সমান নয়। তুমি মন্দ প্রতিহত করো উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো।"
➥তৃতীয় ধাপ: ন্যায়, আত্মসম্মান ও সীমা নির্ধারণ
ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান: আত্মীয়তার সম্পর্ক যেন অন্যায়কে সমর্থন না করে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ঈমানের দাবি, যদিও তা নিজের বা পরিবারের বিরুদ্ধে যায়।সূরা আন-নিসা (৪), আয়াত ১৩৫: "হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকো আল্লাহর সাক্ষী হিসেবে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়।"আল্লাহর অবাধ্যতায় আনুগত্য নয়: যদি কোনো আত্মীয় পাপ কাজে লিপ্ত হতে বা আল্লাহর অবাধ্য হতে চাপ দেয়, তবে তার আনুগত্য করা যাবে না। তবে দুনিয়াবি বিষয়ে তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে।সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৫: "আর যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছুকে শরিক করতে চাপ দেয়, যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তাহলে তুমি তাদের কথা মেনো না; তবে দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করবে..."অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক ও মূর্খদের এড়িয়ে চলা: আত্মসম্মান রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা। কোরআন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যক্তি বা আচরণ উপেক্ষা করার নির্দেশনা দেয়:মূর্খদের এড়িয়ে চলা: যখন অজ্ঞ লোকেরা উস্কানিমূলক বা তিক্ত কথা বলে, তখন তাদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে শান্তি কামনা করে এড়িয়ে যাওয়াই মুমিনের বৈশিষ্ট্য।সূরা আল-ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩: "রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যখন তাদের (অশালীন ভাষায়) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে, ‘সালাম’ (শান্তি)।"সূরা আল-আ'রাফ (৭), আয়াত ১৯৯: "ক্ষমাশীলতা অবলম্বন করো, সৎকাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলো।"অর্থহীন কথাবার্তা উপেক্ষা করা: যে সকল মজলিসে পরনিন্দা, মিথ্যা বা বাজে কথা হয়, সফল মুমিনরা তা থেকে নিজেদের বিরত রাখে।সূরা আল-মু'মিনূন (২৩), আয়াত ৩: "এবং যারা অসার কথাবার্তা থেকে বিরত থাকে।"দ্বীন নিয়ে উপহাসের স্থান ত্যাগ করা: যেখানে আল্লাহর আয়াত বা দ্বীন নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা হয়, নিজের ঈমান রক্ষার জন্য সেই স্থান ত্যাগ করা আবশ্যক, যতক্ষণ না তারা সেই আলোচনা পরিবর্তন করে।সূরা আন-নিসা (৪), আয়াত ১৪০: "...যখন তোমরা শুনবে আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করা হচ্ছে এবং তা নিয়ে উপহাস করা হচ্ছে, তখন তাদের সাথে বসবে না..."
➥চতুর্থ ধাপ: জুলুম অসহনীয় হলে আত্মরক্ষা
সূরা আশ-শূরা (৪২), আয়াত ৪১-৪৩: "আর যে ব্যক্তি অত্যাচারিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই... অভিযোগ কেবল তাদের বিরুদ্ধে যারা মানুষের উপর জুলুম করে... আর যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে, এটা দৃঢ় সংকল্পের কাজ।"
করণীয় পদক্ষেপের সারসংক্ষেপ 📢
আত্মসংযম ও ধৈর্য ধারণ: তাৎক্ষণিক আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করুন।ক্ষমা করার মানসিকতা: সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিন, কারণ আল্লাহ ক্ষমাশীলদের ভালোবাসেন।উত্তম আচরণ দ্বারা মন্দ প্রতিহত করা: তাদের মন্দ আচরণের জবাবে উত্তম আচরণ করুন, যা পরিস্থিতি অনুকূলে আনতে পারে।
✨গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
🔗পরামর্শদাতা: প্রধানত কিসের ভিত্তিতে পরামর্শ দিবেন?
আল-কুরআনের আলোকে যারা মানুষের সমস্যা সমাধান বা ফয়সালা করবেন (যেমন বিচারক, মধ্যস্থতাকারী, নেতা বা পরামর্শদাতা), তাদের কিছু বিশেষ যোগ্যতা ও গুণাবলীর অধিকারী হওয়া অপরিহার্য। এই গুণাবলী নিশ্চিত করে যে সিদ্ধান্তটি ন্যায়সঙ্গত, পক্ষপাতহীন এবং ঐশী নির্দেশনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। নিচে কোরআনের আলোকে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা ও গুণাবলী আয়াতসহ উল্লেখ করা হলো:
🔖আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করা:
আর তাদের মধ্যে ফয়সালা করো আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর তাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকো, যেন তারা তোমাকে আল্লাহর নাযিলকৃত কোনো বিধান থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। সূরা আল-মায়েদা ৫:৪৯
🔖ন্যায়পরায়ণতা (আদল ও কিস্ত):
ফয়সালাকারীকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, আত্মীয়তা বা শত্রুতার ঊর্ধ্বে উঠে সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তার হকদারদের কাছে পৌঁছে দিতে। আর যখন তোমরা মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা-সূরা আন-নিসা ৪:৫৮
🔖জ্ঞান ও প্রজ্ঞা (ইলম ও হিকমাহ):
সমস্যার গভীরে পৌঁছানো, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান (শরীয়তের জ্ঞানসহ) এবং পরিস্থিতি বোঝার জন্য প্রজ্ঞা থাকা আবশ্যক। জ্ঞান ছাড়া সঠিক ফয়সালা করা সম্ভব নয়।
তিনি (আল্লাহ) যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দেওয়া হয়, তাকে তো প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়। আর বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ উপদেশ গ্রহণ করে না-2:269
🔖নিরপেক্ষতা ও প্রভাবমুক্ত থাকা কিন্তু কতটা?
ফয়সালাকারীকে ধনী-গরিব, আপন-পর, শক্তিশালী-দুর্বল ইত্যাদি ভেদাভেদ না করে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো প্রকার চাপ বা প্রলোভনের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া যাবে না।
হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো আল্লাহর জন্য সাক্ষী হিসেবে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে ধনী হোক বা দরিদ্র, আল্লাহ উভয়েরই অধিকতর আপন। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে গিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে তোমরা যা করো, আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন-সূরা আন-নিসা ৪:১৩৫
🔖তাকওয়া (আল্লাহভীতি/সচেতন/গার্ড):
ফয়সালাকারীকে অবশ্যই আল্লাহভীরু হতে হবে। তার অন্তরে এই ভয় থাকতে হবে যে, তার প্রতিটি কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাকওয়া তাকে অন্যায় ও পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত রাখবে
"...ন্যায়বিচার করো, তা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী..."-আল-মায়েদা ৫:৮
Leave a Comment